
সাগরের ঢেউয়ে ডুবে যাওয়া মানুষের জীবন বাঁচাতে যারা দিনরাত পাহারা দেয়, সেই লাইফ গার্ড কর্মীদের আর হয়তো দেখা যাবে না কক্সবাজার সৈকতে। সেপ্টেম্বরের পরই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বহুল প্রশংসিত ‘সিসেফ লাইফ গার্ড’ প্রকল্প। ১১ বছর ধরে সৈকতের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা ও পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া এই পাইলট প্রকল্পটি এখন বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ’ (সিপিআইআরবি) জানায়, ১১ বছরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সিসেফ লাইফ গার্ড কর্মীরা মোট ৭৯৫ জন ডুবে যাওয়া পর্যটককে জীবিত উদ্ধার করেছেন।
সিসেফ প্রজেক্টের ফিল্ড টিম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল। জেলা প্রশাসনের অনুরোধে দাতা সংস্থা রয়াল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট (আরএনএলআই) ৬ মাস ও পরবর্তীতে ৩ মাস বাড়িয়েছে। বর্তমানে আমরা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় পেয়েছি। এরপর প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে।’
তিনি জানান, জেলা প্রশাসন, বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সঙ্গে একাধিক বৈঠকে প্রকল্প চালু রাখার চেষ্টা করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুখবর নেই।
সিপিআইআরবি’র সিনিয়র অ্যাডভাইজার ডা. শাইকুল ইসলাম হেলাল বলেন, ‘দাতা সংস্থা স্পষ্ট করে জানিয়েছে, প্রকল্পটির মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। আমরা ইতোমধ্যে সচিবালয় ও মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। জেলা প্রশাসক অত্যন্ত আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন। কিন্তু উচ্চপর্যায়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই করার নেই।’
পর্যটকদের মতে, লাইফ গার্ড কর্মীরা না থাকলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গোসলে নামা হয়ে উঠবে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
ঢাকা থেকে কক্সবাজারে ঘুরতে আসা পর্যটক আসিফুর রহমান বলেন, ‘সাগরের পাড়ে নামতেই দেখি, একেকটা পয়েন্টে লাইফ গার্ড সদস্যরা হুইসেল বাজিয়ে পর্যটকদের নিরাপদ জায়গা নির্দেশ দিচ্ছেন। সাঁতার না জানলেও তাদের উপস্থিতি আত্মবিশ্বাস দেয়। তারা না থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে।’
কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক তুষার তুহিন বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা দেখেছি, একেকটি দুর্ঘটনার মুহূর্তে লাইফ গার্ড কর্মীরা নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা শুধু উদ্ধারই করেন না, সাগরে নামার সময় কীভাবে নিরাপদে থাকা যায়, সেই দিকনির্দেশনাও দেন। এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে তা হবে পর্যটনের জন্য বড় ক্ষতি।’
প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে কেবল পর্যটকদের নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে না, অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে এই প্রকল্পে যুক্ত ২৭ জন দক্ষ লাইফ গার্ড কর্মীর জীবন-জীবিকাও। দীর্ঘদিন ধরে যারা সীমিত সম্মানী, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশ ও স্বল্প সুযোগ-সুবিধা নিয়েও দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার জায়গা থেকে কাজ করে আসছেন, আজ তারাই সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার মুখোমুখি।
এই কর্মীদের অধিকাংশই দীর্ঘসময় ধরে প্রতিদিন সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে জীবন বাঁচানোর মিশনে যুক্ত থেকেছেন। অনেকেই রয়েছেন যারা বিকল্প চাকরি বা আয়-রোজগারের সুযোগ না থাকলেও কেবল মানুষের জীবন রক্ষার ব্রত নিয়ে যুক্ত ছিলেন এই প্রকল্পে।
তারা বলছেন, ‘পেছনে থাকা পরিবারের মুখ চেয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অসংখ্যবার- শুধু একটাই চিন্তা নিয়ে; কাউকে যেন প্রাণ হারাতে না হয়।’
লাইফ গার্ড টিমের সদস্যরা বলেন, ‘এটা শুধু একটা চাকরি ছিল না। এটা ছিল ভালোবাসার জায়গা- মানুষকে বাঁচানোর তাগিদ থেকে কাজ করেছি। এখন যদি প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শুধু সমুদ্রের তীরে নয়, আমাদের ঘরেও ঝড় বইবে।’
তাদের চোখে এখন শুধু নিজের ভবিষ্যৎ নয়, সাগরে নামা প্রতিটি পর্যটকের নিরাপত্তা নিয়েও বড় ধরনের শঙ্কা।
একজন কর্মী বলেন, ‘আমরা যদি না থাকি, কে দেখবে কে কোথায় ডুবে গেল? কে দেবে সতর্ক সংকেত? কে নামবে উদ্ধার অভিযানে?’
সিসেফ লাইফ গার্ড টিম লিডার ওসমান গনি বলেন, ‘আমরা নিজেদের জীবনবাজি রেখে কাজ করছি। কাজের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা এটা করে যাচ্ছি। কিন্তু এখন তো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি। কোথায় যাবো, কী করবো? শুধু আমরা না, আমাদের পরিবারেরাও আতঙ্কে আছে।’
এখনো সময় আছে- এই অভিজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে কক্সবাজার সৈকতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পরিকল্পনার আহ্বান জানান তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘কক্সবাজার দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন নগরী। বছরে লাখ লাখ পর্যটক এখানে আসেন। অথচ সৈকতের মতো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যদি কার্যকর উদ্ধার কর্মসূচি না থাকে, তবে সেটা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’
কক্সবাজার বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা চাই এই প্রকল্পটি যেন অব্যাহত থাকে। অন্তত সরকার এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিক। আরএনএলআই চলে যেতেই পারে, কিন্তু এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা কখনো ফুরাবে না।’
সাগরপারে নিরাপত্তা আর উদ্ধার অভিযানে ‘লাইফ গার্ড’ যেন কেবল অতীতের গল্প না হয়ে যায়- এমনটাই এখন চায় কক্সবাজারবাসী।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, ‘প্রকল্পটি ২০২৪ সালেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। আমরা দাতা সংস্থাকে অনুরোধ করে মেয়াদ কিছুদিন বাড়িয়েছি। এখন মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তারা হয়তো ভিন্নভাবে বিষয়টি বিবেচনা করছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সার্বিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর