
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা ডিসি ইকোপার্কের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) ও কাবিটা কর্মসূচির পাঁচটি প্রকল্পের সাড়ে ২৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩০শে জুন শেষ হলেও কাজ বাস্তবায়ন না করেই অর্থ তুলে নেওয়ার অভিযোগের তীর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মনসুর রহমান এবং প্রকল্পের দুই পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) সভাপতি, সংরক্ষিত ইউপি সদস্য জরিমন নেছা ও ইউপি সদস্য ফেরদৌসী আক্তারের দিকে।
জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় সাহারবাটি ইউনিয়নের ভাটপাড়া ডিসি ইকোপার্কে শিশু পার্কে রাইড স্থাপন, ফেন্সিংকরণ ও রংকরণ বাবদ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, পার্কে ওয়াশরুম সংস্কার ও পিকনিক সেড মেরামত বাবদ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, পার্কে অস্থায়ী দোকান সেড নির্মাণ বাবদ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় ডিসি ইকোপার্কের শিশুপার্ক থেকে বধ্যভূমি, কাজলার পাড় থেকে আশ্রয়ণমুখী রাস্তা এইচবিবি করণ ও দোকানের সামনের মাঠে মাটি ভরাটকরণ বাবদ ৮ লাখ টাকা, পার্কের প্রধান গেট নির্মাণ ও গেটের পাশের মাটি ভরাটকরণ বাবদ ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, এসব প্রকল্পের কাজ না করেই অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইকো পার্কের ভেতরে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ নামমাত্র এস্টিমেট ছাড়া নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়েছে। এইচবিবি করণ, আংশিক গেট নির্মাণ ও অস্থায়ী দোকানের সামনে মাটি ভরাট করা হয়েছে। যতটুকু মাটি ভরাট হয়েছে, তা পার্কের একমাত্র পর্যটন স্থান বধ্যভূমির সামনে থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে। শিশু পার্কের রাইডগুলো ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে, যা যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। টয়লেটগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। জঙ্গল আর কাদায় পার্কে দাঁড়ানোর উপায় নেই। প্রকল্পের কাজের মেয়াদ গত ৩০শে জুন শেষ হলেও দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হয়নি। সর্বোপরি পার্কে পর্যটকদের উপভোগ করার মতো কিছুই নেই।
ডিসি ইকো পার্কের ইজারাদার আসমাউল হুসনা জানান, পার্কের পাঁচটি প্রকল্পের কাজ এস্টিমেট ছাড়া সঠিকভাবে না হয়ে সবই তাল-তামাশা হচ্ছে। দৃশ্যমান কিছুই হয়নি। কাজের টাকা প্রকল্প কর্মকর্তা ও দুই পিআইসির যোগসাজশে লুট হয়ে গেছে। এছাড়া বাইরে থেকে মাটি কেনার কথা থাকলেও পার্কের মধ্য থেকে মাটি উত্তোলন করে মাটি ভরাট করা হয়েছে। পিকনিক সেড নির্মিত হয়নি। বাথরুমের বেহাল দশা। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে এইচবিবি করণ করা হয়েছে। এমনকি পর্যটকদের বসার জায়গাও নেই। তিনি আরও বলেন, একজন গার্ড থাকলেও তিনি ডিউটি করেন না। এভাবে চলতে থাকলে পার্ক পর্যটকশূন্য হয়ে পড়বে এবং একজন ইজারাদার হিসেবে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
পার্কের মুদি দোকান মালিক জয় জানান, পার্কের পরিবেশ আগের থেকে খারাপ হয়ে গেছে। কোনো পর্যটক আসে না, দোকানে বেচাকেনাও নেই। এছাড়া তাঁর বাবা শফি মিয়া শিশুপার্ক ইজারা নিয়েছেন, সেখানে যে রাইডগুলো ছিল সব কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শিশুদের জন্য রাইডগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পুরনো রাইডগুলো সংস্কার করা এবং নতুন রাইড স্থাপন করার কথা থাকলেও এখনো কোনো কাজই হয়নি। এতে তাঁরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। পার্কে ঘুরতে আসা পর্যটক মশিউর রহমান জানান, জেলায় একটি মাত্র পার্ক যেখানে দেখার মতো কোনো কিছু নেই। পরিবেশ ভালো নেই। বাথরুমের অবস্থা বেহাল। চারিদিকে ঝোপ-ঝাড়ে ভরা। এমন অবস্থা হলে দিন দিন জেলার একমাত্র পার্কটি অবহেলায় বন্ধ হয়ে যাবে। এতে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাবে তেমনি পর্যটকশূন্যতায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বে।
প্রকল্পের পিআইসি সভাপতি, সাহারবাটি ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য জরিমন নেছা ও ফেরদৌসী আক্তার মাটি বাইরে থেকে না কিনে পার্কের মধ্য থেকে উত্তোলন করার কথা স্বীকার করে বলেন, কাজের কোনো এস্টিমেট পাননি। এস্টিমেট ছাড়া কিছু কাজ হয়েছে। বাকি কাজও চলমান। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ ও টাকা উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে দুই পিআইসি বলেন, বৃষ্টির কারণে সঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে পারেননি। আর টাকা উত্তোলনের ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মনসুর রহমান জানেন। সাহারবাটি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আসমাতারা খাতুন বলেন, "এই কাজটি সম্পর্কে আমি খুব একটা অবগত নই।" প্রকল্প সম্পর্কে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মনসুর রহমান কোনো তথ্য দেননি। একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ রয়েছে প্রকল্প নিয়ে সাংবাদিকদের কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না।
কাজ না করে বিল উত্তোলনের ব্যাপারে গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ার হোসেন বলেন, নিয়মে বলা আছে কাজ করে বিল উত্তোলন করতে হবে। কাজ না করে পিআইসিরা যদি বিল সাবমিট করে টাকা তুলে নেন, তাহলে পিআইও প্রকল্প পরিদর্শন করে কাজ বুঝে নেবেন। আর কাজের ব্যাপারে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে, তদন্ত শেষে আপডেট পাওয়া যাবে।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) রেজওয়ানুর রহমান বলেন, লিখিত অভিযোগ দিলে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সর্বশেষ খবর