
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার দুর্গম চর বাঘুটিয়া প্রতি মুহূর্তে তীব্র ভাঙনের কবলে পড়ছে। যমুনার স্রোতে প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, আবাদি জমি ও মানুষের স্বপ্ন। গত দুই মাসে অন্তত দুই শতাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়ে আশ্রয়হীন হয়েছে।
প্রায় এক যুগ আগেও চর বাঘুটিয়ার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার। নদী ভাঙনের কারণে বর্তমানে তা নেমে এসেছে প্রায় ১৫ হাজারে। কয়েক হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে ছিন্নমূল হয়েছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে কিংবা রাস্তার ধারে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, যমুনা নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন (ড্রেজিং) করার কারণে ভাঙনের গতি ও তীব্রতা আরও বেড়েছে। চর বাঘুটিয়ার পাশেই ড্রেজারের মাধ্যমে দিন-রাত বালু উত্তোলন করা হলেও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ বিষয়ে বারবার প্রতিবাদ জানালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় কৃষক শহিন মিয়া বলেন, ড্রেজার বসিয়ে নদীর বুক খুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, আর সেই স্রোতে আমাদের বাড়িঘর ভেঙে নদীতে চলে যাচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ জানিয়েও কোনো ফল পাচ্ছি না।
চর বাঘুটিয়ার কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী পরিবারসহ অন্যত্র চলে যাওয়ায় পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ দিনমজুরি কিংবা নৌকা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে। ফলে এলাকার শিক্ষার হার মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে।
চরের সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক ভাঙনে নদীতে বিলীন হওয়ায় এখন রোগীদের চিকিৎসার জন্য যমুনা নদী পার হয়ে জেলা শহর মানিকগঞ্জে আসতে হচ্ছে। নৌকা যোগে নদী পার হয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে গিয়ে অনেক সময় রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন। এছাড়া ডায়রিয়া, আমাশয় ও চর্মরোগে আক্রান্ত হলেও সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।
চরের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস ছিল কৃষি। কিন্তু হাজার হাজার বিঘা আবাদি জমি নদীতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকেরা এখন বেকার। মাছও আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজের খোঁজে চলে যাচ্ছেন। নারীরাও জীবিকা হারিয়ে পড়েছেন অসহায় অবস্থায়। অনেক পরিবার ঋণ নিয়ে দিন পার করছে।
স্থানীয় কৃষক শহিদুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগে ভাঙন ছিল, কিন্তু এত তীব্র ছিল না। এখন ড্রেজার যেদিক থেকে বালু তোলে, সেদিক দিয়েই আমাদের বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে যায়। আমার ৪০ বিঘা জমি ছিল, সব নদীতে চলে গেছে। দুইটা ঘর বানিয়েছিলাম, সেগুলোও নদী খেয়ে ফেলেছে। আমরা গ্রামবাসী একসাথে প্রতিবাদও করেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সরকার শুধু দেখছে, কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আমরা এখন কোথায় যাবো, কীভাবে বাঁচবো বুঝতে পারছি না।
চরের গৃহবধূ সুলেখা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এই গ্রামে আমার জন্ম, বিয়েও হয়েছে এখানেই। স্বামীর কবর নদীর তলায় চলে গেছে। এখন আমার ঘরবাড়িও গেল। নদী আমাদের সব নিয়ে নিচ্ছে আমাদের স্মৃতি, আমাদের ভিটেমাটি। এখন যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। তিন সন্তান নিয়ে রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়েছি। ঠিকমতো খেতে পারি না, সন্তানদের পড়াশোনাও করাতে পারছি না। প্রতিদিন ভয় হয়, কালকে আবার কোন দিকে ভাঙন ধরবে।
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ জানায়, আমি স্কুলে পড়তাম, কিন্তু সংসারের অবস্থা খারাপ বলে এখন বালির নৌকায় কাজ করি। বাড়িঘরও নদীতে চলে যাচ্ছে। যদি বাড়ি না থাকে, স্কুলেও আর যাওয়া হবে না। ভিটে হারালে আমরা কোথায় থাকবো? পড়াশোনা বাদ দিয়ে হয়তো সারাজীবন দিনমজুরি করতে হবে।
প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল মালেক স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই চরে আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকে দেখেছি জমি চাষ করে মানুষ বাঁচছে। গরু-ছাগল পালতাম, ধান-ভুট্টা-কালাই ফলাতাম এই জীবনেই সুখ ছিল। এখন সেই দিন নেই। নদী ভাঙনে আমার জমি, ঘর, এমনকি কবরস্থানও ভেঙে গেছে। আমি চেয়েছিলাম এখানেই মরবো, এখানেই কবর হবো। কিন্তু এখন তো কবরস্থানও নদীতে তলিয়ে গেছে। মনে হয় আমরা বেঁচে থাকলেও ইতিহাসে আর এই চরের নাম থাকবে না।
চিকিৎসা সংকটে ভুক্তভোগী সুফিয়া খাতুন জানান, ডেলিভারির ব্যথা উঠলে স্বামী নৌকা যোগে আমাকে মানিকগঞ্জ হাসপাতালে নিয়েছিল। নদী পার হতে অনেক সময় লেগেছিল, রাস্তাঘাটও খারাপ ছিল। হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। ডাক্তাররা বলেছিলেন, আরেকটু দেরি হলে আমার আর সন্তানের জীবন দুজনেরই শেষ হয়ে যেত। এরকম কষ্ট আমরা প্রতিদিন ভোগ করি। কোনো ক্লিনিক নেই, ওষুধের দোকান নেই, অসুখ হলে জীবন বাঁচা-মরা ভাগ্যের হাতে।
বেকার কৃষক আজগর শেখ হাহাকার করে বলেন, আগে ধান, গম, ভুট্টা ফলিয়ে ভালোই চলতেছিল। আমার ৫০ বিঘা জমি ছিল। এখন এক বিঘাও নেই, সব নদী খেয়ে ফেলেছে। আমি এখন দিনমজুরি করি কখনো কারও জমিতে ঘাস কাটি, কখনো নদীতে মাছ ধরি। এইভাবেই বাঁচার চেষ্টা করছি। সন্তানদের দুইবেলা খাওয়াতে পারি না। কখনো শুধু ভাত, কখনো লবণ দিয়ে ভাত খেতে হয়। নদী আমাদের শুধু ভিটেমাটি খায়নি, আমাদের সম্মানও কেড়ে নিয়েছে। এখন আমরা ভূমিহীন, কাজহীন, ভবিষ্যৎহীন।
বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আমজাদ হোসেন বলেন, প্রতিবছর নদীভাঙনের কবলে বসতবাড়ি ও আবাদি জমি হারিয়ে শত-শত মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায়। এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে যমুনা নদী আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার অতিমাত্রায় ভাঙছে। চলতি মৌসুমে আমার ইউনিয়নের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, রাস্তা ও আবাদি জমি ভাঙনের শিকার হয়েছে।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, এরই মধ্যে নদীর তীরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর ভাঙন ঠেকাতে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে চরাঞ্চলে বালু বেশি থাকায় সামান্য পানির স্রোতেই ভাঙন দেখা দেয়। তাই এসব এলাকায় প্রতিবছরই ভাঙন রোধে কাজ করতে হয়।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর