
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ইকসু) গঠন ও নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আট শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসির কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ইকসু গঠন আন্দোলন’ ব্যানারে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, শনিবার (২৩ আগস্ট) সকাল ১১টায় প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি ও শিক্ষার্থীদের গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের বুরহান উদ্দিন, আল ফিকহ অ্যান্ড ল বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের হাসিব আল সজিব, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের (মাস্টার্স) রাকিবুল ইসলাম, আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের সাজ্জাতুল্লাহ শেখ, আল ফিকহ অ্যান্ড ল বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের সায়েম আহমেদ, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের আহমাদ আল আলামিন ও ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের জুলকারনাইন দোলন।
লিখিত বক্তব্যে বক্তারা বলেন, প্রায় ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ হয়নি। বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে দেয়নি। অথচ শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা সমিতি ও কর্মচারীদের নিয়মিত নির্বাচন হয়, কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। এর ফলে ছাত্ররা অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে এবং দেশ মেধাবী নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য, হল দখল ও গেস্টরুম কালচার থামছে না। ছাত্র সংসদ গঠিত হলে কোনো একক রাজনৈতিক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে না।
বক্তারা আরও বলেন, প্রশাসনকে ইকসু গঠনের জন্য স্মারকলিপি দেওয়া হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; বরং বারবার আইনের দোহাই দেখিয়ে ইকসু গঠনকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং রাকসু নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ গঠন ও নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে তাদের আইনে না থাকা সত্ত্বেও বেরোবি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে চাইলে যেকোনো যৌক্তিক বিষয়ই অর্জন করা সম্ভব।
তারা আরও বলেন, প্রশাসন যেহেতু ইকসু গঠনে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, তাই এবার থেকে রাজপথের ভাষায় ইকসু আদায়ের লক্ষ্যে তারা একমত হয়েছেন। তারা স্পষ্ট ভাষায় জানান, ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের অধিকার এবং কোনো অজুহাতে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। ইকসু কোনো একক ব্যক্তির বা একক সংগঠনের নয়, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ হাজার শিক্ষার্থীর। ইকসুর দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে এই ‘ইকসু গঠন আন্দোলন’-এর সাথে একাত্মতা প্রকাশের আহ্বান জানানো হয়।
বক্তারা সাজিদ আব্দুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তদন্তের অগ্রগতি জানার অধিকার দাবি করেন। তারা প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে সাজিদ হত্যার তদন্তের মনিটরিং সেল গঠনের এবং দ্রুত খুনিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
এ সময় সম্মেলনস্থলে উপস্থিত ছিলেন শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদ, ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক এস এম সুইট, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি ইসমাইল হোসেন রাহাত, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ গালিব ও খেলাফত ছাত্র মজলিসের সভাপতি সাদেক আহমেদ।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে বসার জায়গায় অব্যবস্থাপনা ও ‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা’ উপস্থিতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে কয়েক দফা হট্টগোল হয়। সাবেক সহ-সমন্বয়ক মোবাশশির আমিন অভিযোগ করেন, অভ্যুত্থানবিরোধী আওয়ামীপন্থি শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতেই তারা কারো সাথে সমন্বয় না করেই হঠাৎ এ সংবাদ সম্মেলন করেছে। এসব নিয়ে ফের হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র আন্দোলন, খেলাফত ছাত্র মজলিশ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ সক্রিয় সংগঠনগুলোর নেতারা ও উপস্থিত শিক্ষার্থীরা সম্মেলন বর্জন করে বেরিয়ে যান। তারা এই সম্মেলনকে বিভাজন সৃষ্টির পাঁয়তারা এবং ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোকে যথাযথ সম্মান না করার অভিযোগ করেন। পরে তাদের সম্মেলন আহ্বানকারীদের ‘ভুয়া’ বলে স্লোগান দিতে দেখা যায়। এছাড়াও, ইকসু নিয়ে শিক্ষার্থীদের দুটি পক্ষ ‘ইকসু গঠন আন্দোলন’ নামে আলাদা দুটি ফেসবুক পেজে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সাহেদ আহম্মেদ বলেন, “সেখানে আমাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম সেখানে আমাদের কথা বলার সুযোগ থাকবে সেই কারণেই গিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু দেখতে পাইনি। তারা যে পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, সেসব কার্যক্রমের মধ্যেও আমাদের কোনো স্থান রাখা হয়নি। তাছাড়া, আমাদের মাত্র আধা ঘণ্টা আগে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।”
অভিযোগের বিষয়ে সম্মেলনের আয়োজক সায়েম আহমেদ বলেন, “যৌক্তিক দাবি থেকেই আমাদের এই আন্দোলন। কোনো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নয়। যে কেউ আমাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে পারেন, আমরা সবাইকেই স্বাগত জানাচ্ছি।”
শাখা ছাত্র শিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, “ইকসুর জন্য আহ্বান করায় আমরা সেখানে দলমত নির্বিশেষে সবাই যাই। তবে এখানে আসার পর মনে হয়েছে কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে নেতাবনে যাওয়ার প্রবণতা কাজ করছে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। বিভাজন নয়, বরং সকল শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আন্দোলন হওয়া উচিত ছিল। ছাত্র সংসদ কোনো দল বা কতিপয় লোকের সম্পদ নয়, এটি সকল শিক্ষার্থীর দাবি। এজন্য আন্দোলনকে আরও ইনক্লুসিভ করে বোনদের অংশগ্রহণসহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক প্ল্যাটফর্মে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।”
ইবির সাবেক সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, “ইকসু নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে- আমাদের এভাবেই জানানো হয়েছিল। তাই আমরা এখানে এসেছি। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে রাজনৈতিকভাবে কোনো ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো মারামারি কিংবা হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমি খেয়াল করেছি, এখানে ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। এর পেছনে কারা আছে আমি জানি না, তবে সন্দেহ হয়—ইবি ক্যাম্পাসে যেভাবে ‘সুন্দরভাবে’ চলছে, সেখানে হয়তো কোনো বিভাজন তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। আমরা চাই সবাইকে নিয়েই একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন।”
পরে ওইদিন রাত ১১ টার দিকে বিষয়টি সমাধানের প্রেক্ষিতে ‘ইকসু গঠন আন্দোলন’-এর আয়োজকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতারা। সেখানে তারা বিদ্যমান প্ল্যাটফর্মটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় সেটি ভেঙে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভাগীয় প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গঠন করার প্রস্তাব দেন। তবে আয়োজকরা এখনো তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেননি বলে জানা গেছে।
আয়োজকদের একজন বুরহানউদ্দিন বলেন, তারা আমাদের প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমরা একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবো।
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর