আট বছর আগে রাখাইনের সেনা অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এখনো ঘরে ফিরতে পারেনি। দীর্ঘদিনের অনিশ্চিত জীবন ও শিবিরের দুর্দশার মধ্যে বিশ্ব নেতাদের সামনে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের দাবি জানাচ্ছেন তারা।
রোববার (২৪ আগস্ট) উখিয়ার ইনানীতে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সংলাপে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং ফর রিপ্যাট্রিয়েশন’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা, প্রবাসী রোহিঙ্গা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কূটনীতিকরা। তারা শিবিরের কষ্টকর জীবন তুলে ধরে দ্রুত নিরাপদে মাতৃভূমি আরাকানে ফেরার আকুতি জানান।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি এ সংলাপকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। পরবর্তী সময়ে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়েও প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়নি। মিয়ানমারের সরকারের তালবাহানা, অস্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার শর্ত- সব মিলিয়ে বারবার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। ফলে রোহিঙ্গারা আট বছর পরও আশ্রিত থেকে গেছে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে।
গত রমজানে কক্সবাজার সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছিলেন- আগামী ঈদে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে উৎসব করবে। সেই প্রত্যাশায় সরকারি পর্যায়ে কাজও চলছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতিকে নতুন করে জটিল করে তুলেছে। ফলে আবারও রোহিঙ্গাদের মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে- প্রতিশ্রুত প্রত্যাবাসন কি আদৌ বাস্তবে রূপ নেবে?
এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্তিতে কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানীতে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সংলাপ। রোববার (২৪ আগস্ট) বিকেল সোয়া ৫টায় সেনা নিয়ন্ত্রিত হোটেল বে-ওয়াচে উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
‘কনফিডেন্স বিল্ডিং ফর রিপ্যাট্রিয়েশন’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিদেশি কূটনীতিক, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা।
অধিবেশনের মূল আলোচনায় উঠে এসেছে আশ্রয়শিবিরের দুর্বিষহ বাস্তবতা ও মাতৃভূমিতে ফেরার আকুতি। সম্প্রতি ক্যাম্পবাসীর ভোটে নির্বাচিত কমিউনিটি প্রতিনিধি খিন মংয়, লাকি করিম ও উম্মে সালমার সঞ্চালনায় অধিবেশন হয়।
রোহিঙ্গা ফটোগ্রাফার সাহাত জিয়া হিরো বলেন, বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের কথা তুলে ধরার সুযোগ দেওয়ায় আমরা কৃতজ্ঞ। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও বাংলাদেশের জনগণের অবদান আমরা চিরকাল মনে রাখব।
কমিউনিটি নেতা মৌলভি সৈয়দ উল্লাহর বক্তব্যে উঠে আসে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের দাবি। তিনি বলেন, জাতিগত নির্যাতনের শিকার হয়ে আমরা আজ অনিশ্চিত জীবনে আছি। দ্রুত নিরাপদে আরাকানে ফিরতে চাই। এজন্য বিশ্বকে আমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
এছাড়া ফোরকান মির্জা, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, হুজ্জৌত উল্লাহ, আবদুল আমিন, মুজিফ খানসহ অনেকে বক্তব্য দেন। প্রবাসী রোহিঙ্গারাও আলোচনায় অংশ নেন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে।
অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম।
বিদেশি অতিথিদের মধ্যে ছিলেন- মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ বিশেষ প্রতিনিধি টমাস এইচ. অ্যান্ড্রুজ। জাতিসংঘের বাংলাদেশে আবাসিক প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স। স্বাধীন তদন্তকারী মেকানিজমের প্রধান নিকোলাস কুমজিয়ান। ইউএনএইচসিআরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হাই কমিশনার রউফ মাজু। পাশাপাশি বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণঅধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরাও ছিলেন আলোচনায়।
এছাড়া কূটনৈতিক মিশন, আন্তর্জাতিক সংগঠন, জাতিসংঘের সংস্থা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও যোগ দেন।
সংলাপকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রথম বড় সম্মেলন আখ্যা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে কীভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ উন্মুক্ত করা যায়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণই এ সংলাপের অন্যতম উদ্দেশ্য।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। সংস্থাটির যোগাযোগ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন বলেন, সংকটের সমাধান নিহিত আছে মিয়ানমারে। রোহিঙ্গারা পরিস্থিতি অনুকূল হলে নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে এবং স্বেচ্ছায় ঘরে ফিরতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার ও মাঠপর্যায়ের মানবিক অংশীদারদের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর কাজ করে যাচ্ছে। এর লক্ষ্য হলো প্রায় সোয়া মিলিয়ন রোহিঙ্গার জন্য টেকসই সমাধান খোঁজা।
এ তিন দিনব্যাপী সংলাপকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে ১০৭টি দেশ অংশ নেবে। কক্সবাজারের এই সংলাপ মূলত আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি ফেরানো এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যৌথ কৌশল খোঁজার অংশ।
শেষ দিনে (২৬ আগস্ট) দেশি-বিদেশি অতিথিরা উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন। তাদের সামনে প্রত্যক্ষভাবে তুলে ধরা হবে আশ্রয়শিবিরের মানবেতর বাস্তবতা।
বাংলাদেশ সরকার বারবার বলছে- যেকোনো মূল্যে রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা হবে। তবে বাস্তবতা হলো, মিয়ানমারের পরিস্থিতি অনুকূলে না এলে কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বলছে, সঙ্কটের মূল কারণ মিয়ানমারে সমাধান না হলে দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়।
এমন অবস্থায় কক্সবাজারের এই সংলাপ বিশ্ব নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণে কতটা সফল হয়- সেটিই এখন দেখার বিষয়। এমনটাই বলছেন সচেতন মহল।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর