
কক্সবাজার শহরের প্রাণভোমরা বাঁকখালী নদীকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে প্রশাসন শুরু করেছে বহুল প্রতীক্ষিত উচ্ছেদ অভিযান। সোমবার সকাল থেকে জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)-এর যৌথ উদ্যোগে নদীর দুই তীর জুড়ে গড়ে ওঠা শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু হয়। ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
অভিযান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড এবং সেনাবাহিনী মাঠে ছিল। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বাঁকখালী নদী ও তার দুই তীর দখলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে।
জানা গেছে, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে নদীর তীর ভরাট করে গড়ে উঠেছে দোকানপাট, বসতঘর এবং বহুতল ভবন। রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল ও স্থানীয় দখলদারদের ছত্রছায়ায় নদীর নাব্যতা ক্রমে ধ্বংসের পথে। একসময় দেড় মাইল প্রস্থের নদী এখন কোথাও কোথাও মাত্র ২০০ ফুট প্রস্থে সংকুচিত।
পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন, অন্তত ৩০০ একর প্যারাবন ধ্বংস করে এবং নদী ভরাট করে শত শত স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। নুনিয়াছটা থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারজুড়ে নদী দখলের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। গত এক দশকে সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা তৈরি হয়েছে, যার বড় অংশই রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের দখলে।
ভূমি অফিস ও বিআইডব্লিউটিএ’র পৃথক তালিকায় সহস্রাধিক দখলদারের মধ্যে অন্তত ৩৫০ জন প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম, পৌর বিএনপির সভাপতি রফিকুল হুদা চৌধুরী এবং এবি পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কাশেম। তবে রফিকুল হুদা চৌধুরীর দাবি, তিনি নদীর জমি দখল করেননি, বরং তা পৈত্রিক।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে হাইকোর্টের নির্দেশে জেলা প্রশাসন ৪ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে এবং ৩০০ একর প্যারাভূমি মুক্ত করে। কিন্তু মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে একই জায়গায় ফের স্থাপনা তৈরি শুরু হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের শিথিলতায় নতুন ঘরবাড়ি তৈরির হিড়িক পড়ে।
নদীর বুক জুড়ে শুধু দখলদাররাই নয়, জমেছে বর্জ্যের পাহাড়। কক্সবাজারে প্রতিদিন উৎপন্ন ৯৭ টনের বেশি বর্জ্যের মধ্যে প্রায় ৭০ টন সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। বাকিটা চলে সাগরে। এতে নদীর প্রবাহ আরও সংকুচিত হচ্ছে। নতুন নির্মিত সেতু নদীর নাব্যতাকে আরও কমিয়েছে এবং নৌযান চলাচলে সমস্যা তৈরি করছে।
ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস)-এর চেয়ারম্যান মুজিবুল হক বলেন, অপরিকল্পিত সেতু ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে বাঁকখালী নদী আজ মরণদশায়। নৌযান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে।
গত ২৪ আগস্ট হাইকোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, আগামী চার মাসের মধ্যে সব দখলদার উচ্ছেদ করতে এবং ছয় মাসের মধ্যে বাঁকখালী নদীকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ECA) ঘোষণা করতে। একই সঙ্গে নদীর আরএস জরিপ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ, ম্যানগ্রোভ বন পুনরুদ্ধার এবং নদী সংলগ্ন সব ইজারা বাতিলের নির্দেশ এসেছে। আদালত মামলাটিকে চলমান ঘোষণা করে প্রতিবছর জানুয়ারি ও জুলাই মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দিয়েছে।
জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বাঁকখালীকে তার প্রকৃত রূপ ফিরিয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। কারও প্রভাবশালী পরিচয় কিংবা ক্ষমতার দাপট এখানে কাজে আসবে না।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানান, সম্প্রতি কক্সবাজার সার্কিট হাউসে সমন্বয় সভায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। দ্রুততম সময়ে নদী দখলমুক্ত করা হবে এবং স্থায়ীভাবে নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হবে।
পরিবেশবাদীরা অভিযানকে স্বাগত জানালেও সতর্ক করেছেন, শুধু উচ্ছেদ করলেই হবে না। নদী রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্রম এবং কঠোর মনিটরিং চালু করতে হবে।
তাদের মতে, বাঁকখালী শুধু কক্সবাজার নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। নদী রক্ষা করা গেলে কক্সবাজার উপকূলকে ভবিষ্যতের জলবায়ু সংকট থেকেও অনেকটা সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।
সর্বশেষ খবর