
কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের দক্ষিণ লেদা গ্রাম। এ গ্রামের কৃষক মৃত আবু সামার ছেলে রবিউল আলম (৩৯)। এক দশক আগেও ছিলেন অচেনা এক যুবক। জীবিকার তাগিদে তিনি হ্নীলার একটি কাপড়ের দোকানে দুই- তিন হাজার টাকায় চাকরি করতেন।
এখন তিনি হ্নীলা ও কক্সবাজার শহরের জমির মালিক। লেদায় গড়ে তুলেছেন মার্কেট। হ্নীলা বাজারে একাধিক ভাড়াবাসা, কক্সবাজার শহরে দামী প্লট, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। স্থানীয়দের প্রশ্ন, এই অস্বাভাবিক উত্থানের পেছনে কী রহস্য? পুলিশের নথি বলছে, রবিউল আলম ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় দশ বছর আগে চাকরি ছেড়ে নিজ এলাকায় ফেরেন রবিউল। প্রথমে ছোট্ট একটি কাপড়ের দোকান দেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শুরু হয় তার আর্থিক অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন।
লেদা এলাকায় একের পর এক জমি কিনতে থাকেন তিনি। সেই জমিতে গড়ে তোলেন বহুতল মার্কেট। হ্নীলা বাজারে ভাড়াবাসার মালিক হন। কক্সবাজার শহরে কিনে নেন দামী প্লট। স্থানীয়রা বলছেন, এসব সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য কোটি কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবা আমদানিকারক হিসেবে অন্তত অর্ধশত কারবারি সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম রবিউল। বর্তমানে তার নেতৃত্বে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর হয়ে দেশে ঢুকছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা।
সরকার পরিবর্তনের পর পুরোনো অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মগোপনে চলে যায়। এ সুযোগে তাদের জায়গা দখল করে নেয় রবিউল। এখন বীরদর্পে লাখ লাখ ইয়াবা দেশে আনছে সে।
স্থানীয় সূত্র বলছে, সম্প্রতি তিনি নতুন কৌশলে ব্যবসা চালাচ্ছেন, যাতে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকা যায়। রবিউল এখন ফিশিং ট্রলারের মাধ্যমেই ইয়াবা পরিবহন করছে। নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর হয়ে ট্রলারগুলো পৌঁছায় সরাসরি কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক ও ফিশারিঘাটে। সেখান থেকেই রবিউল ছোট ছোট ডিলারদের হাতে তুলে দেন ইয়াবা। এভাবেই রবিউল অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।
হ্নীলার এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, এত টাকার উৎস কী। রবিউল আগে দোকানে কাজ করত। এখন কোটি টাকার মালিক। এর পেছনে ইয়াবার টাকাই কাজ করেছে।’
পুলিশের তথ্য বলছে, রবিউলের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরের বাড্ডা থানায় মাদক মামলা রয়েছে। কক্সবাজার সদর থানাতেও একাধিক মাদক ও কুমিল্লার বাঙ্গরা বাজার থানায় রয়েছে আরও একটি মামলা।
শুধু মাদক নয়, কক্সবাজার সদর থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মানিলন্ডারিং মামলাও আছে।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ২০১৯ সালের ১৫ জুন। ওইদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেড় লাখ ইয়াবাসহ রবিউল ও তার এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনাটি কক্সবাজারজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়।
কিন্তু কিছুদিন কারাগারে থাকার পর রহস্যজনকভাবে বের হয়ে আসেন তিনি। এরপরও ইয়াবা কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন খোলাখুলিভাবে।
হ্নীলা ও লেদা এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘রবিউলের নাম প্রকাশ্যে বলতে তারা ভয় পান। প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে তার অবস্থান এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, কেউ অভিযোগ তুললে হুমকি পেতে হয়।’
একজন স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী বলেন, ‘রবিউলের কাছে টাকার অভাব নেই। টাকা দিয়ে সে অনেককেই ম্যানেজ করতে পারে। তার বিরুদ্ধে আইনের কোনো শাস্তি কার্যকর হয় না। তাই লোকজন চুপ থাকে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রবিউল নিজের নামে কিছু সম্পদ কিনলেও অনেক সম্পদ রয়েছে স্ত্রী, ভাই ও আত্মীয়স্বজনের নামে। লেদা এলাকায় তার একটি বড় মার্কেট আছে। হ্নীলা বাজারে একাধিক ভাড়াবাসা ও দোকানঘর তার নিয়ন্ত্রণে। কক্সবাজার শহরের ব্যস্ত এলাকায় একটি দামী প্লটও কিনেছেন তিনি। স্থানীয়দের দাবি, ওই প্লটের বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা।
একজন স্থানীয় শিক্ষক বলেন, ‘যে ছেলেটা একসময় কাপড়ের দোকানে কাজ করত, তার এখন এত সম্পদ! শিক্ষার্থীরা দেখে বিভ্রান্ত হয়। ভাবে, ইয়াবা ব্যবসা করলেই ধনী হওয়া যায়।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে থাকা তথ্য বলছে, টেকনাফের ইয়াবা সিন্ডিকেটে রবিউলের অবস্থান এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরকেন্দ্রিক ইয়াবা পাচারেও তার সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে।
মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান এনে কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর নেটওয়ার্কের সঙ্গে তিনি যুক্ত। তার নাম একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে। তবে প্রভাবশালী ও অসাধু কর্মকর্তাদের ছত্রচ্ছায়ায় বারবার বেঁচে যান তিনি। ২০১৯ সালে দেড় লাখ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর রবিউলের সাজা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মামলার অগ্রগতি তেমন হয়নি।
স্থানীয়দের ধারণা, টাকার বিনিময়ে মামলার ফাইল পরিবর্তন করা হয়েছে কিংবা সাক্ষীদের প্রভাবিত করা হয়েছে।
ফলে মামলা চলমান থাকলেও তিনি অবাধে চলাফেরা করে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করছেন।
স্থানীয়দের মতে, রবিউলের উত্থান স্থানীয় সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তরুণরা দেখে, অল্প সময়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। এতে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।
একজন নারী শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের সৎ পথে চলতে শিখাই। কিন্তু তারা দেখে, ইয়াবা ব্যবসায়ী কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। এতে তারা বিভ্রান্ত হয়। সমাজের জন্য এটা ভয়ংকর।’
সচেতন মহল বলছেন, একদিকে একের পর এক মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রমাণ; অন্যদিকে আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে আসা। এভাবে যদি ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বারবার পার পেয়ে যায়, তবে সীমান্ত এলাকায় মাদকের দাপট কমবে না, বরং আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে জানতে রবিউলের মুঠোফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি একসময় মাদক ব্যবসা করতাম, তবে এখন করি না। প্রদীপের আমলে ষড়যন্ত্র করে আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছিল, জেল খেটেছি। এখন এসব ছেড়ে দিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করলে আমি কেঁদে কেঁদে বিচার করব, তখন তোমার বাচ্চাকাচ্চা লেংড়া-লোলা হয়ে যাবে। আমি বিএনপি করি, সে কারণে জামায়াতের লোকজন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।’
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর