
বর্ষায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের দ্বীপের মতো গ্রামগুলো চারপাশ পানিতে টইটম্বুর থাকে। সড়কপথে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব গ্রামের অসহায় মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে এবং জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসার জন্য সরকার নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দিলেও সেগুলো একদিনের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। ব্যবহার তো দূরের কথা, হাওরবাসী সেগুলো চোখেও দেখেনি, কেবল লোকমুখে শুনেছেন। হাওরাঞ্চলের মানুষজন এ কথা জানিয়েছেন, যেন সরকারের সম্পদ ফেলে রাখা হয়েছে।
এসি ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স ৬১ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে সরকার ক্রয় করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দিলেও প্রত্যন্ত এলাকার গরিব ও অসহায় মানুষ এর সুফল পায়নি। অথচ এই খাতে কয়েক কোটি টাকা অপচয় হয়েছে বলে জেলার সচেতন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
জেলার জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও শাল্লা উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাওরাঞ্চলে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের জন্য জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসার জন্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে একটি করে মোট চারটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হলেও একদিনের জন্যও তা ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৩ সালে তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং ২০১৯, ২০২০ সালে অন্যান্য উপজেলায় নৌ-অ্যাম্বুলেন্সগুলো দেওয়া হয়। এরপর থেকেই দিনের পর দিন কোনটি নদীতে, কোনটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে হাওরে ও খালে রাখা হয়। এতে করে দিনে দিনে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের মেশিন, এসি সহ ১৭টি মূল্যবান যন্ত্রাংশ অযত্ন ও অবহেলায় অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। এছাড়াও এর অনেক যন্ত্রাংশই নেই বললেই চলে।
সংশ্লিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দেওয়ার পর থেকে চালক ও তেলের খরচ দেওয়া হয়নি। যার জন্য সরকারের দেওয়া হাওরাঞ্চলের মানুষের জন্য এই বাহনটির সুফল পায়নি কেউ। আর হাওরাঞ্চলের গরিব পরিবারের লোকজন এত ব্যয়বহুল যান চলাচলের সামর্থ্যও রাখে না। তবে সরকারি খরচে চলাচলের সুযোগ হলে এর সুফল পেত জনগণ।
ধর্মপাশা উপজেলার গাছতলা এলাকার বাসিন্দা জীবন মিয়া জানান, "নৌ-অ্যাম্বুলেন্স এইটা কী জিনিস, তাই তো চিনি না, এর সুবিধা কীভাবে পাবো? আমরা গরিব মানুষ অসুস্থ হলে আর জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালে যেতে চাইলে নিজেদের বা ভাড়া করা ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করি।"
জেলার শাল্লা উপজেলার বাসিন্দা আনিসুল হক মুন জানান, "বর্ষায় নৌকা ছাড়া চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। হাসপাতালে বা যেখানেই যেতে হয় নৌকায় করে যেতে হয়। সরকারি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স আছে একটা, এটা তো কখনো রোগী নিয়ে চলাচল করতে দেখিনি। আমাদের এলাকার কারো উপকারে আসেনি। যদি চালু থাকত তাহলে আমাদের উপকার হতো।"
তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের বাসিন্দা সাবিকুন নাহার জানান, "আমরা বছরের ৬-৭ মাস নৌকা দিয়ে হাসপাতালে আসা-যাওয়া করি। টাকা থাকলেই তো চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায় না। রাতে অসুস্থ হলে সকাল ছাড়া হাসপাতালে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। নৌ-অ্যাম্বুলেন্স কী জিনিস চোখেই দেখিনি, এর সেবা পাবো কীভাবে? তবে লোকমুখে শুনেছিলাম নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের কথা।"
তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জুনাব আলী জানান, "দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতায় নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের সুফল ভোগ করতে পারেনি হাওরাঞ্চলের মানুষজন। যদি চালু থাকত তাহলে জরুরি প্রয়োজনে কাজে লাগত। আর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই নৌ-অ্যাম্বুলেন্সগুলো এখন বেহাল অবস্থায় রয়েছে। সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা অপচয় হয়েছে।"
শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচএফপিও ডাঃ দেবব্রত আইচ মজুমদার জানান, "নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি একেবারেই অকেজো হয়ে গেছে আর শুরু থেকে এটি কোনো কাজেই আসেনি। মেশিনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি বোট থেকে খুলে আনার সুযোগ ছিল না, তাই সেভাবেই আছে। এর বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন।"
ধর্মপাশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচওএফপিও ডাঃ সুবীর সরকার জানান, "আমি গত আট মাস আগে যোগদান করেছি। নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের বিষয়ে আমার জানা নেই, খোঁজ নিয়ে জানতে হবে, আর জানাতে হবে।"
জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচওএফপিও মইন উদ্দিন আলমগীর জানান, "২০২০ সালে দেওয়া হয়েছিল। চালক দেওয়া হয়নি, একদিন গাড়ির চালককে দিয়ে চালানোর পর নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে মেশিনগুলো নষ্ট হয়েই পড়ে রয়েছে। নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের বডি থানার সামনে রাখা আছে।"
সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, "নৌ-অ্যাম্বুলেন্স ভালোর জন্য দেওয়া হলেও তা কোনো কাজে আসেনি মানুষের। শুরু থেকে চালক দেওয়া হয়নি, ছিল না তেলের বরাদ্দও। এছাড়াও এই নৌ-অ্যাম্বুলেন্স পরিবহন ব্যয়বহুল, যা হাওর পাড়ের বাসিন্দাদের খরচ বহন করার সামর্থ্যের বাইরে। এখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা হলে প্রত্যন্ত এলাকার গরিব মানুষের উপকার হতো।"
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর