
প্রায় ৩৯ বছর পর মাশুল বাড়ালো চট্টগ্রাম বন্দর। এখন থেকে বন্দর সেবায় গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল গুনতে হবে ব্যবহারকারীদের।
আজ সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকেই এ নতুন মাশুল কার্যকর। রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান সই করা এক প্রজ্ঞাপনে এ গেজেট প্রকাশিত হয়।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা একটি জাহাজ আবার ফিরতি পথের নোঙর তোলা পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫৬ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রতিটি জাহাজের সব ধরনের সেবার প্রয়োজন না হলেও অধিকাংশ সেবাই সমুদ্রগামী জাহাজগুলো গ্রহণ করে থাকে। বিদেশের কোনো বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছার পর জাহাজটিকে জেটিতে আনার জন্য পাইলট পাঠানো, টাগবোট সার্ভিস, পানি সরবরাহ, ক্রেন চার্জ, জাহাজ ভিড়ানো, জাহাজ থেকে কন্টেনার নামানো কিংবা ওঠানো, খোলা পণ্য ওঠানো–নামানোসহ পণ্য ডেলিভারি পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিটি কাজের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট হারে মাশুল আদায় করে। মার্কিন ডলারে নেওয়া এই অর্থকে বন্দরের ট্যারিফ বা সেবার মূল্য বলা হয়।
প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী, প্রত্যেকবার বন্দর এলাকায় প্রবেশের জন্য প্রতি গ্রজ টনের জন্য দশমিক ৩০৬ ডলার, পোর্ট লিমিটের মধ্যে লাইটার ও ট্যাংকারের ভ্যাসেল ওয়ার্কিং চার্জ ধরা হয়েছে প্রতি গ্রজ টনে দশমিক ০১৭ ডলার। এর সঙ্গে ডেঞ্জারাজ গুডস ভ্যাসেলের ক্ষেত্রে ঘোষিত চার্জের ২৫ শতাংশ, ডেড ভ্যাসেলের জন্য ৫০ শতাংশ, লাইটারেজের জন্য ৫০ শতাংশ, ডিলে/ওভার স্টে চার্জ হিসেবে ৫ শতাংশ অতিরিক্ত মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে।
বন্দরে জাহাজ প্রবেশের জন্য জাহাজের প্রতি মুভমেন্টের জন্য সর্বনিম্ন পাইলটিং চার্জ ধরা হয়েছে ৮০০ ডলার। তাছাড়া ১০ হাজার গ্রজ টনের ওপরের ভ্যাসেলের জন্য প্রতি গ্রজটনে দশমিক শূন্য ৮ ডলার চার্জ ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে ব্রেকিং জার্নি হলে ঘোষিত চার্জের সঙ্গে ৫০ শতাংশ, ডেড ভ্যাসেলের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ, প্রবেশ বাতিলের জন্য প্রতিবারের জন্য ২০০ ডলার, নাইট নেভিগেশন ভ্যাসেলের জন্য ২৫ শতাংশ, বার্থ শিফটিংয়ের জন্য প্রতি মুভমেন্টে ৮০ ডলার, কর্ণফুলী নদীর বাইরের অংশে পাইলটিংয়ের জন্য ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত মাশুল নির্ধারণ করা হয়।
টাগ ব্যবহারের চার্জ হিসেবে প্রত্যেক মুভমেন্টে প্রতি ২০০টন থেকে ৫ হাজার গ্রজটনের জন্য কর্ণফুলী নদীর মধ্যে ৬১৫ ডলার, বাইরে ১২৩০ ডলার, ৫০০০ টন থেকে ১০ হাজার গ্রজটনের জন্য কর্ণফুলীর মধ্যে ১২৩০ ডলার, বাইরে ২৪৬০ ডলার, ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার গ্রজটনের জন্য ভেতরে ২০৫০ ডলার, বাইরে ৪১০০ ডলার এবং ২০ হাজার গ্রজটনের ওপরের জন্য ভেতরে ৩৪১৫ ডলার ও বাইরের জন্য ৬৮৩০ ডলার নির্ধারণ করা হয়। এর সঙ্গে ডিজেবল কিংবা ডেব ভ্যাসেলের ক্ষেত্রে মূল চার্জের বাইরে ১০০ শতাংশ- বাতিলের জন্য ৫০ শতাংশ, শিফটিংয়ের জন্য ৫০ শতাংশ, কর্ণফুলী নদীর মধ্যে ৪ ঘণ্টার বেশি সার্ভিসের জন্য ২৫ শতাংশ, কর্ণফুলী নদীর বাইরে ৬ ঘণ্টার বেশি সার্ভিসের জন্য ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত চার্জ ধরা হয়েছে।জাহাজ বন্দরের জেটিতে বার্থিংয়ের জন্য প্রতি গ্রজটনে প্রতি ঘণ্টায় দশমিক ০০৪ ডলার, প্রতিবারে বার্থিং আনবার্থিংয়ের জন্য ৯৪ পয়েন্ট ৩২ ডলার, সমুদ্রগামী জাহাজের ক্ষেত্রে প্রতি জাহাজে দৈনিক ২২৪ দশমিক ৮৫ ডলার এবং সমুদ্রগামী নন এমন জাহাজের ক্ষেত্রে জাহাজপ্রতি দৈনিক ২২ দশমিক ৪৯ ডলার মাশুল নির্ধারণ করা হয়। এর সঙ্গে নোটিশ করার পর বার্থ ত্যাগ না করলে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ১০০ শতাংশ ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ৩০০ শতাংশ, ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ৪০০ শতাংশ, ৩৬ ঘণ্টার বেশি ডিলে করলে ৯০০ শতাংশ অতিরিক্ত চার্জ নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে শিফটিংয়ের জন্য প্রতিবারে ৪৭ দশমিক ১৬ ডলার মাশুল ধরা হয়।
জাহাজে পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে মেইন সাপ্লাই লাইন থেকে প্রতি ১০০০ লিটারের জন্য ২ দশমিক ৯২ ডলার, বন্দরের লরি দিয়ে (৫ কিলোমিটারের নিচে) প্রতি ১০০০ লিটারের জন্য ৬ পয়েন্ট ২৩ ডলার, ৫ কিলোমিটারের ওপরে প্রতি ১০০০ লিটারের জন্য ৮ দশমিক ২৩ ডলার, বন্দরের ওয়াটার বোট ব্যবহার করে কর্ণফুলী নদীর মধ্যে প্রতি ১০০০ লিটারের জন্য ১২ দশমিক ৪৬ ডলার এবং পতেঙ্গা লাইট হাউজ থেকে ৭ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ১০০০ লিটারের জন্য ১৮ দশমিক ৬৯ ডলার, পতেঙ্গা লাইট হাউজ থেকে ৭ নটিক্যাল মাইলের বাইরে প্রতি ১০০০ লিটারের জন্য ২৪ দশমিক ৯৬ ডলার এবং বন্দরের বাইরের কোন পক্ষ থেকে পানি সরবরাহ নিলে প্রতি ১০০০ লিটারে ওয়াসার দরের ২০ শতাংশ বেশি হারে ওভারহেড চার্জ ধরা হয়েছে।
ওয়েস্ট হ্যান্ডলিং চার্জের ক্ষেত্রে কর্ণফুলী নদীর মধ্যে স্বল্পদূরত্বে প্রতিবারের সেবায় ২৪৫৬ দশমিক ৯৯ ডলার, কর্ণফুলী নদীর বাইরে প্রতিট্রিপের সেবায় ৪০৬৩ দশমিক ১৫ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।
বন্দরের ক্রেন ব্যবহারের জন্য (কি গ্যান্ট্রি, মোবাইল হার্বার, একই ধরনের অন্য যন্ত্র) প্রতি মুভমেন্টে পণ্যভর্তি কনটেইনার প্রতি ২১ ফুটের নিচে ২০ দশমিক ৮০ ডলার, ২১ থেকে ৪০ ফুটের জন্য ৩১ দশমিক ২০ ডলার এবং ৪০ ফুটের ওপরের জন্য ৩৫ দশমিক ১০ ডলার, খালি কনটেইনারের ক্ষেত্রে প্রতি ২১ ফুটের নিচে ১০ দশমিক ৪০ ডলার, ২১ থেকে ৪০ ফুটের জন্য ১৫ দশমিক ৬০ ডলার এবং ৪০ ফুটের ওপরের জন্য ১৭ দশমিক ৫৫ ডলার, জেটি ক্রেন ব্যবহারের জন্য ক্রেনপ্রতি প্রতি ৮ ঘণ্টার জন্য ১০ টনের নীচে ৫৮ দশমিক ২৪ ডলার, ১০ থেকে ৪০ টনের জন্য ১৭৪ দশমিক ৭২ ডলার এবং ৪০ টনের ওপরে ২৯১ দশমিক ২০ ডলার এবং হ্যাজ কভারের জন্য প্রতিবারে প্রতি প্যানটনে ৩৫ দশমিক ১০ ডলার চার্জ নির্ধারণ করা হয়।
জানা গেছে, গত জুনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৪১ শতাংশ হারে বর্ধিত ট্যারিফ প্রস্তাব করলে আপত্তি জানায় বন্দর ব্যবহারকারীরা। ২ জুন নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ে ট্যারিফ বিষয়ে এক মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা তাদের আপত্তির বিষয় তুলে ধরে। কিন্তু শেষপর্যন্ত বন্দরের প্রস্তাবনা অনুসারেই ট্যারিফ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।
বর্ধিত ট্যারিফ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, আমরা আপাতত ট্যারিফ যেন বাড়ানো না হয়, সেটা বলেছিলাম। আর যদি বাড়াতেই হয় তাহলে যেন সেটা ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সেটা বলেছিলাম। কিন্তু এখন ৪১ শতাংশ হারে ট্যারিফ কার্যকর করা হয়েছে। এটা সার্বিকভাবে আমদানি-রপ্তানিকারকদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।
চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন খরচ বেড়েছে। তাই ট্যারিফ না বাড়িয়ে কার্যক্রম চালু রাখা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে। ৪০ বছর আগেকার কাঠামো দিয়ে ট্যারিফ আদায় করা হচ্ছে। এটি একটি অবাস্তব ব্যাপার। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কম মূল্যে বিশ্বের আর কোথাও শিপিং সেক্টরের সেবা পাওয়া যায় না। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার ট্যারিফ কাঠামো চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং পোর্ট কেলাংয়ে নিয়মিত জাহাজ চলাচল রয়েছে। এসব জাহাজ ওই বন্দরগুলোতে বাড়তি ট্যারিফ দিচ্ছে, অথচ চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে অজুহাতের আশ্রয় নিচ্ছে।
বন্দরের হিসাবে, প্রস্তাবিত বর্ধিত মাশুল কার্যকর হলে সব ধরনের পণ্যে কেজিপ্রতি মাশুল বাড়বে গড়ে ১৪ পয়সা। বর্তমানে কেজিপ্রতি ৩৫ পয়সা মাশুল দিতে হয়। সেই হিসাবে গড়ে মাশুল বাড়ছে ৪১ শতাংশ। কন্টেইনারের মতো সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজগুলো বন্দর সুবিধার খুব সামান্যই ব্যবহার করে। যেমন বাল্ক জাহাজের বেশির ভাগই সাগরে নোঙর করে ছোট জাহাজে পণ্য স্থানান্তর করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দর দিয়ে মোট পণ্যের ৫৯ শতাংশই খালাস হয়েছে বহির্নোঙরে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যে ট্যারিফ আদায় করছে তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ অর্থবছরে ৫টি খাতে ট্যারিফ বাড়ানো হয়। তবে বাকি ৫১ খাতের ট্যারিফ আদায় করা হয় ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত হারে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় ট্যারিফ বাড়ানোর আলোচনা বা চিন্তাভাবনা করলেও তা সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালে ট্যারিফ পুনঃনির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পায়নি। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাব দাখিল করলে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দিয়ে আন্তর্জাতিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ট্যারিফ কাঠামো তৈরির নির্দেশনা প্রদান করে। সরকারের নির্দেশনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ স্পেনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইডিএম কনসাল্টিং ও লোকিকফোরামকে ট্যারিফ কাঠামো নির্ধারণের পরামর্শক নিয়োগ করে। ওই প্রতিষ্ঠান নানা বিষয়ে পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন দেশের বন্দরের সেবার মূল্য পর্যালোচনা করে একটি প্রস্তাব দাখিল করে। ২০২০ সালে জমা দেওয়া ওই প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে পাঁচ বছর পর নতুন ট্যারিফ কাঠামো তৈরি এবং কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর