
উপকূলীয় জেলা বরগুনা ইলিশ মাছের জন্য বিখ্যাত, যেখানে পায়রা, বিষখালী এবং বলেশ্বর নদী মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। প্রতি বছর এখান থেকে আহরিত হতো প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন ইলিশ, যা দেশের উৎপাদনের একটি বড় অংশ। কিন্তু আজ সেই ইলিশের রাজত্বে ইলিশ নেই।
ইলিশশূন্য হয়ে পড়েছে দেশের সবচেয়ে সুস্বাদু ইলিশের ভাণ্ডার বরগুনার বিষখালী নদী। শুধু বিষখালী নয়, পায়রা, বলেশ্বর ও আন্ধারমানিক নদীর মোহনায় ডুবোচর, পায়রা নদীতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গরম পানি এবং পলিথিন বর্জ্যের কারণে ইলিশশূন্য হয়ে পড়েছে এই নদীগুলো। ঐতিহ্যবাহী বিষখালির ইলিশের স্বাদ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে হলে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ মাছের সংকট দেখা দিয়েছে, যা জেলে ও ব্যবসায়ীদের জন্য চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধ জালের ব্যবহার, মা ইলিশ নিধন এবং পরিবেশগত কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিষখালী নদীর মোহনায় ডুবোচর উঠেছে ৬.৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে, বলেশ্বর নদীতে ১১.৪২ কিলোমিটার, আন্ধারমানিক নদীতে ১২ কিলোমিটার এবং পায়রা নদীতে ১৫ কিলোমিটার এলাকায়।
পায়রা নদীর জেলে মিজান বলেন, ইলিশ মাছ সাধারণত লবণাক্ত পানিতে থাকে। তবে প্রজননের সময় ডিম পাড়ার জন্য এরা নদীর মিষ্টি পানিতে আসে। সে সময় ডুবোচরে বাধাগ্রস্ত হয়ে আবার গভীর সমুদ্রে ফিরে যায়। ডুবোচরগুলো খনন না করলে নদীতে ফিরবে না ইলিশ।
বিষখালী নদীর মোহনায় কয়েক কিলোমিটার এলাকায় জেগে উঠেছে ডুবোচর। তাই এই নদীতে প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়ে গভীর সমুদ্রে ফিরে যাচ্ছে ইলিশ। ডুবোচরের কারণে দিশেহারা জেলেরা বলছেন, জাল ফেললেই ইলিশের বদলে উঠে আসছে পলিথিন বর্জ্য।
তালতলীর পায়রা নদীর জেলে মামুন বলেন, প্রতিদিন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গরম পানি ও পলিথিন পায়রা নদীতে ফেলা হচ্ছে, যার কারণে ইলিশ মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। জাল ফেললে মাছের পরিবর্তে উঠে আসে পলিথিন। জেলে পেশা ছেড়ে অনেকেই অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
শুধু বিষখালী নয়, ডুবোচর ও মানবসৃষ্ট কারণে ইলিশ কমেছে পায়রা, বলেশ্বর ও আন্ধারমানিক নদীতেও।
ডালভাঙ্গা গ্রামের জেলে নাইম বলেন, দিনভর জাল ফেলে খরচের টাকাও তুলতে পারছেন না। তাই অনেকেই লোকসানের মুখে ইলিশ শিকার বন্ধ করেছেন এবং অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন। ইলিশের ভাণ্ডার আজ নিস্তব্ধ।
বরগুনা শহরের ক্রেতা আল-আমিন বলেন, স্বাদ বেশি, দামেও বেশি—লোভনীয় এই ইলিশের স্বাদ। শেষ প্রজন্ম না হোক বিষখালির ইলিশের। নদী খনন আর দূষণমুক্ত করে ইলিশের অভয়ারণ্য হিসেবে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীগুলো প্রস্তুত করা হোক।
বরগুনার এই চারটি নদীতে অন্তত ৮০ হাজার জেলে ইলিশ শিকার করতেন। এখন জেলের সংখ্যা অর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে। নদী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন জেলেরা। প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট কারণে হুমকির মুখে ইলিশের ভাণ্ডার।
ধরিত্রী রক্ষায় ‘আমরা ধরা’ বরগুনার সমন্বয়ক মুসফিক আরিফ বলেন, ডুবোচর খননের পাশাপাশি নদী দূষণ বন্ধ না করলে হারিয়ে যাবে মিঠা পানির সুস্বাদু ইলিশ। পাশাপাশি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গরম পানি ও বর্জ্য পায়রা নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। নদী রক্ষায় আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বড় আন্দোলন শুরু করবো।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মহসীন বলেন, আমাদের এতদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি—মোহনা থেকে নদীর প্রবেশপথের গভীরতা অনেক কমে গেছে, যার কারণে ইলিশের অভিপ্রয়াণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বরগুনার চারটি নদীর খনন দরকার। তাই আমরা নদীগুলো খননের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি।
পায়রা ও বিষখালী নদীসহ উপকূলীয় অঞ্চলের নদীগুলো এখন ইলিশশূন্য, যার ফলে জেলে ও মৎস্য শ্রমিকরা বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, যদিও এগুলো ইলিশের প্রজনন ও মাইগ্রেশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অভয়াশ্রম। এই নদীগুলোতে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে ইলিশের পোনা নিধন, পরিবেশগত সমস্যা এবং প্রজনন পথে বাধার কারণে ইলিশের দেখা মিলছে না।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর