
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কায়িক পরীক্ষায় ধরা পড়লো চাঞ্চল্যকর কাণ্ড - দেশজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে ‘জাপানি’ হিসেবে পরিচিত শার্প ও জেনারেল ব্র্যান্ডের বড় সংখ্যক এসি-ফ্রিজ আসছে বাস্তবে চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও তাইওয়ান থেকে; অথচ কাগজে-কলমে তা গোপন রাখা হচ্ছে। সূত্রে জানা যায়, এসকোয়্যার গ্রুপ (এসকোয়্যার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড ও এসকোয়্যার হেবি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড) এই পণ্যগুলো আমদানি করে মিথ্যা দেশীয় ঘোষণায় বা ‘জাপানি প্রোডাক্ট’ দাবিতে বাজারজাত করেছে-ফল হিসেবে বেশ কিছু চালান আটক হয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেই চীন থেকে আগত ২৮৭টি শার্প ব্র্যান্ডের ফ্রিজ আটক করে কাস্টমস; সংরক্ষিত মূল্য প্রতি পিস প্রায় ২৭ হাজার টাকা হলেও বাজারে একই পণ্যের দাম ছিল প্রায় ৬৪ হাজার টাকা।
পরে কাস্টমসের নিলামে অংশ নেয় ওই গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান-নামমাত্র মূল্যে পণ্যগুলো ফিরিয়ে নেওয়ার কৌশলে চালানগুলো আবারও এসকোয়্যারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের নজরে এ পর্যন্ত ৯টি চালান খালাস বন্ধ হয়েছে (৭টি-নভেম্বর/ডিসেম্বর ২০২৪, ২টি-চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল), যার প্রতিটি চালানে বিপুল পরিমাণ এসি-ফ্রিজ, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও যন্ত্রাংশ ছিল। বিষয়টি জানাজানি হবে, সেজন্য অত্যন্ত গোপনে পণ্যগুলো খালাস নেয়ার চেষ্টা করে এসকোয়্যার গ্রুপের দুইটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। খালাস না করতে পেরে শেষে কাস্টমসের সঙ্গে যোগসাজস করে নিলাম থেকে নামমাত্র মূল্যে এসব পণ্য কৌশলে নিয়ে নেয় এসকোয়্যার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড। জনস্বার্থে উন্মোচিত এই কেলেঙ্কারির বাজারে ভোক্তার ভরসা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমসেরও ফাঁকফোকর ও নিলামপ্রক্রিয়ায় যোগসাজসে নিলাম থেকে নামমাত্র মূল্যে কারসাজির মাধ্যমে ১৩৯টি ফ্রিজ, ৬২৯টি ফ্রিজ এবং আরও কয়েকশ পিস ফ্রিজ-একইভাবে নিলামে নিজেদের নামে তুলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
নিলামে জালিয়াতি করে ‘শার্প ফ্রিজ’ নামমাত্র মূল্যে নিয়েছে এসকোয়্যারের দুই প্রতিষ্ঠান
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একাধিক সূত্রমতে, এসকোয়্যার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড চীন থেকে ২ কন্টেইনারে ২৮৭টি ‘সার্প ব্র্যান্ডের ২২০ লিটারের’ ফ্রিজ আমদানি করে। ২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস চালানটি কায়িক পরীক্ষা করে। তাতে পণ্যের গায়ে কান্ট্রি অব অরিজিন চীন লেখা ছিলো। তবে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ লেখা ছিলো না। জাপানি ব্র্যান্ডের পণ্য চীন থেকে আমদানি করায় তা আটক করা হয়। চলতি বছরের ১৫ জুলাই কাস্টম হাউস ২৮৭টি ফ্রিজের সংরক্ষিত মূল্য দেখায় ৭৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬০৬ টাকা। সে হিসেবে প্রতিটি ফ্রিজের দাম দাঁড়ায় প্রায় ২৭ হাজার টাকা। অথচ ২২০ লিটারের একটি শার্প ফ্রিজের বাংলাদেশের বাজারে মূল্য প্রায় ৬৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ নামমাত্র মূল্যে কাস্টমস ফ্রিজের দাম প্রস্তাব করে। ৩০ জুলাই নিলামে ৪টি প্রতিষ্ঠান ও ৪ জন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করে। তবে চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসকোয়্যার ইলেকট্রনিক্সের এইচএস ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাকি তিনটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ৪ জন ব্যক্তি এসকোয়্যার ইলেকট্রনিক্সের। অর্থাৎ নিলামে কৌশলে ভুয়া ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান দেখি
য়ে কাস্টমসকে ম্যানেজ করে এই চালানটি নিজেরা নামমাত্র মূল্যে নিয়ে নেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ, জাপানি ব্র্যান্ডের পণ্য চীন থেকে আমদানি হয়েছে-বিষয়টি জানাজানি হলে বিক্রিতে প্রভাব পড়বে, সেজন্য এই জালিয়াতি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এরকম ৯টি চালান একইভাবে নিলামে তারা কারসাজি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অপরদিকে, ২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর অপর একটি চালানের কায়িক পরীক্ষা করা হয়। তাতে ‘শার্প ২২০ লিটারের’ ১৩৯টি ফ্রিজ কায়িক পরীক্ষায় পাওয়া যায়। কান্ট্রি অব অরিজিন ছিলো চীন। ১৩৯টি ফ্রিজের সংরক্ষিত মূল্য দেখায় ৩৩ লাখ ৬৩ হাজার ৬৯০ টাকা। যাতে প্রতিটি ফ্রিজের দাম দাঁড়ায় প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এই নিলামে অংশ নেয় ছয়টি প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে একটি এসকোয়্যার ইলেকট্রনিক্সের, বাকি পাঁচটি নামমাত্র। একই বছরের ১০ ডিসেম্বর অপর একটি চালানের কায়িক পরীক্ষা করা হয়। যাতে ৬২৯টি একই ব্র্যান্ডের ফ্রিজ পাওয়া যায়। কান্ট্রি অব অরিজিন চীন লেখা এসব পণ্য নিলামে সংরক্ষিত মূল্য প্রস্তাব করা হয় ২ কোটি ৫৪ হাজার ৭৯৬ টাকা। সে হিসেবে প্রতিটি ফ্রিজের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩২ হাজার টাকা। এই চালানেও এসকোয়্যারের সেই প্রতিষ্ঠান চালানটি নিয়ে নেয়। ১৭ নভেম্বর এসকোয়্যার হেবি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের একটি চালানের ১১টি কন্টেইনার কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এতে ৮৬৬টি ফ্রিজ ও ২৬ হাজার ৮৫৩ কেজি ফ্রিজের যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। যার কান্ট্রি অব অরিজিন থাইল্যান্ড। নিলামে সংরক্ষিত মূল্য প্রস্তাব করা হয় এক কোটি ৩৬ লাখ ৮০ হাজার ৪৬৩ টাকা। নিলামে সেই একই প্রতিষ্ঠান, ভুয়া একটি প্রতিষ্ঠান ও তাদের একজন ব্যক্তি অংশ নেয়। পণ্য প্রায় একই প্রতিষ্ঠান।
জালিয়াতি করে জেনারেল ব্র্যান্ডের এসি ও যন্ত্রাংশ নিলাম থেকে নিয়েছে এসকোয়্যার হেবি ইন্ডাস্ট্রিজ
সূত্র আরও জানায়, চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল এসকোয়্যার হেবি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের একটি চালান কায়িক পরীক্ষা করা হয়। যাতে কান্ট্রি অব অরিজিন থাইল্যান্ড লেখা ১ হাজার ২০০ পিস এসি, ১ হাজার ২০০ পিস এসির আউটডোর কেসিং, প্রায় ৩৬৬২ কেজি প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল পাওয়া যায়। চালানটির সংরক্ষিত মূল্য প্রস্তাব করা হয় ১ কোটি ৮৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬০ টাকা। এই পণ্য চালানের নিলামেও এসকোয়্যারের সেই প্রতিষ্ঠান, একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও এসকোয়্যারের এক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। এসকোয়্যারের সেই প্রতিষ্ঠান পণ্যটি পায়। ২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর অপর একটি চালান কায়িক পরীক্ষা করা হয়। যাতে কান্ট্রি অব অরিজিন থাইল্যান্ডের ১ হাজার ৭২৪ পিস এসির ইনডোর কেসিং ও স্প্লিট পাওয়া যায়। ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৫ হাজার ৫৪২ টাকা সংরক্ষিত মূল্য প্রস্তাব করা চালানটির নিলামে এসকোয়্যারের সেই প্রতিষ্ঠান, দুইটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও এসকোয়্যারের এক ব্যক্তি অংশ নেন। চালানটি পান একই প্রতিষ্ঠান। এসকোয়্যার হেবি ইন্ডাস্ট্রিজের অপর একটি চালান ১২ ডিসেম্বর কায়িক পরীক্ষা করা হয়। তাতে ৭৩১২ কেজি ওজনের এসি ও এসির যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। কান্ট্রি অব অরিজিন থাইল্যান্ডের চালানটি ৬৮ লাখ ৪৬ হাজার ১০০ টাকা সংরক্ষিত মূল্য প্রস্তাব করা হয়। এই নিলামেও এসকোয়্যারের একটি প্রতিষ্ঠান পান। তবে আরো তিনটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও এসকোয়্যারের এক ব্যক্তি নিলামে অংশ নেন।
শার্প ব্র্যান্ডের ১০৮৯টি ওয়াশিং মেশিন একই জালিয়াতি করে আমদানি
সূত্রমতে, ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর এসকোয়্যার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের একটি চালান কায়িক পরীক্ষা করা হয়। যাতে কান্ট্রি অব অরিজিন ইন্দোনেশিয়া লেখা ৮-১১ কেজি ধারণ ক্ষমতার ১ হাজার ৮৯টি শার্প ব্র্যান্ডের ওয়াশিং মেশিন পাওয়া যায়। নিলামে এসব ওয়াশিং মেশিনের ৩ কোটি ২৪ লাখ ৩ হাজার ১৬৯ টাকা সংরক্ষিত মূল্য প্রস্তাব করা হয়। সে হিসেবে প্রতিটির মূল্য দাঁড়ায় কম বেশি ২৯,৫০০ টাকা। অথচ ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী দেশে শার্প ব্র্যান্ডের প্রতিটি ওয়াশিং মেশিনের মূল্য ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এই নিলামেও এসকোয়্যারের সেই প্রতিষ্ঠান চালানটি পান। তবে আরো তিনটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও এসকোয়্যারের দুই ব্যক্তি অংশগ্রহণ করে। শার্প ব্র্যান্ডের ওয়াশিং মেশিনের অপর একটি চালানও একইভাবে এই প্রতিষ্ঠান বাগিয়ে নেয়। চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালের একটি চালান কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এতে থাইল্যান্ডের তৈরি ১৬ হাজার ১৫ কেজি পণ্যের সংরক্ষিত মূল্য ১ কোটি ৩৪ লাখ ৬৯ হাজার ৭২৭ টাকা প্রস্তাব করা হয়। চালানটিতে সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভুয়া একটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেন এবং চালানটি সেই প্রতিষ্ঠান পান।
ব্র্যান্ড থাকলেও জালিয়াতি করে আমদানি হচ্ছে। এতে ডুপ্লিকেট ভার্সন বা রিকন্ডিশন্ড পণ্য আমদানি করাও হতে পারে। আমদানি করার পর তা নিজেদের কারখানায় নিয়ে জাপানি ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগিয়ে বাজারজাত করা হতে পারে। এর ফলে একদিকে ক্রেতা ঠকছে। অন্যদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসকোয়্যারের জালিয়াতির বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো ফ্রিজ এসি এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণের জন্য বিএসটিআই কিংবা কোন দপ্তর কাজ করে না। এমনকি এদের অনুমোদিত সিল থাকে না। ফলে বিদেশ থেকে বিশেষ করে জাপান ও তাইওয়ানের কনডেসর এবং সলিউশনের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে এগুলি চীন থেকে নিম্নমানের কম খরচে আমদানি করা হয়। ফলে প্রায়ই দেখা যায় দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতিষ্ঠানগুলি হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করলেও জনগণের জীবন নিয়ে খেলা করছে আবার জনগণের পকেট কাটছে।
এ ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট মান নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা প্রদান করে নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরী। একই সাথে আমদানিকৃত পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা-পূর্বক বাজারজাত যাতে করা হয় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর যারা জাপান এবং তাইওয়ান থেকে আমদানির ঘোষণা দিয়ে নিম্নমানের চায়না পন্য আমদানি করছে তাদেরকে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর