
আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হওয়ায় খাগড়াছড়ির সদর উপজেলার পাশাপাশি গুইমারা উপজেলা প্রশাসনও ১৪৪ ধারা জারি করেছে। এর মধ্যে জেলার গুইমারা উপজেলায় রামসু বাজার এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা দেখা দেয়। এতে সেনাবাহিনী তাদের নিবৃত্ত করতে গেলে পাহাড়িদের হামলায় এক মেজরসহ ১৩ সেনা সদস্য আহত হন। পরে ফাঁকা গুলি ছুড়ে অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় সেনাবাহিনী। এর মাঝে দুর্বৃত্তরা বাজারে আগুন ধরিয়ে দিলে কিছু দোকানপাট পুড়ে যায়। এতে কয়েকজন অবরোধকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তাৎক্ষণিক ভাবে হতাহতের সংখ্যা জানা না গেলেও পরে সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩ জন অবরোধকারী মারা যান বলে জানা যায়। নিহতদের বিস্তারিত পরিচয় এখনো জানা যায়নি, তবে তাঁরা সবাই গুইমারার বাসিন্দা। এই ঘটনায় গুইমারা জুড়ে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
খাগড়াছড়িতে প্রশাসনের অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ জারির মধ্যেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছে পাহাড়িরা। শনিবার রাতে জুম্ম ছাত্র জনতার ব্যানারে এ অবরোধের ডাক দেওয়া হয়। এতে পিকেটার হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি সড়কে ব্যাপক নারী পিকেটারের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, ফলে পরিস্থিতি আরও বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়েছে।
খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সহ বিভিন্ন উপজেলার আঞ্চলিক সড়কে টায়ার পুড়িয়ে এবং গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করছে পিকেটাররা। এতে পুলিশ, বিজিবি এমনকি সেনাবাহিনীর গাড়িও আটকে রাখছে নারী পিকেটাররা। ফলে জেলা থেকে উপজেলা এবং উপজেলা থেকে জেলায় সহজে কেউ যাতায়াত করতে পারছেন না। পিকেটারদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথা কাটাকাটি হলেই সামনে এগিয়ে এসে হস্তক্ষেপ করছেন নারী পিকেটাররা।
এদিকে খাগড়াছড়ির এই উদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকারের সভাপতিত্বে সভায় পাহাড়ি-বাঙালি প্রতিনিধি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। প্রশাসনের দেওয়া ১৪৪ ধারা মেনে যার যার ঘরে অবস্থান করতে পাহাড়িদের প্রতি আহ্বান জানান পার্বত্য উপদেষ্টা।
এর আগে রবিবার সকালে খাগড়াছড়ি পৌর শহর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনা ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সেই সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় খাগড়াছড়ি শহর ও উপজেলা সদরে ৭ প্লাটুন বিজিবিও মোতায়েন রয়েছে। সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে শহরের দোকানপাট ও হোটেল মোটেল। শুক্রবার রাতে সাজেকে আটকে পড়া দুই হাজারের বেশি পর্যটককে সেনা নিরাপত্তায় গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় গত শনিবার দুপুরে পৌর শহর ও সদর উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। শনিবার দুপুরে এ আদেশ জারির পর ১৪৪ এর মধ্যেই ঘটেছে পাহাড়ি-বাঙালি ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। শনিবার বিকালে খাগড়াছড়ির মহাজন পাড়ায় পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা দেখা দিলে এক পাহাড়ি লোককে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায়। পরে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে ২ পাহাড়ি এবং ২৩ বাঙালি সহ ২৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ২৪ জন খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ১ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে জেলা জুড়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুরে নিপীড়ন বিরোধী জুম্ম ছাত্র জনতার ব্যানারে মহাসমাবেশ শেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গাড়িতে হামলা চালিয়েছে পাহাড়ি যুবকরা। খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের সামনে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কে এ ঘটনা ঘটে। এতে গাড়ির চালক সেনা সদস্য আহত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া সেদিনের ভিডিওগুলোতে দেখা যায় একটি সেনাবাহিনীর গাড়ির দিকে ইট-পাটকেল, লাঠি-সোঁটা নিয়ে তেড়ে যায় পাহাড়ি যুবকরা। এসময় কোনো কারণ ছাড়াই তারা সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। এতে গাড়ির চালকের হাতে আঘাত লাগে এবং গাড়ির সামনের গ্লাস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনা অত্যন্ত শান্তভাবে মোকাবিলা করে সেনাবাহিনীর এ টিম। এরপর সড়কের পাশে থাকা মোটরসাইকেলের গ্যারেজে হামলা চালায় এই উপজাতি যুবকরা। এসময় গ্যারেজের বড়-ছোট টায়ার নিয়ে যেতে দেখা গেছে ভিডিওতে।
এর আগে নিপীড়ন বিরোধী জুম্ম ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক স্লোগান দিতে শোনা যায়। তারা সেনাবাহিনীকে অকথ্য ভাষায় গালাগালও দেয়।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল সন্ধ্যায় বলেন, 'খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ নিরাপত্তায় যৌথভাবে কাজ করছে। নতুন করে যাতে আর কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।'
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, 'খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তা পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আজ আমরা পার্বত্য উপদেষ্টা মহোদয় সহ মতবিনিময় করেছি। এতে পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে যার যার ঘরে অবস্থান করতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।'
সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে: গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরে সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া এক মারমা কিশোরী ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় শয়ন শীল নামে একজনকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রাখে পুলিশ। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ বিক্ষোভ মিছিল করে পাহাড়ি বিভিন্ন সংগঠনগুলো। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে জুম্ম ছাত্র জনতার ব্যানারে অর্ধদিবস সড়ক অবরোধের ডাক দেয় মারমা সম্প্রদায়ের একটি সংগঠনের খাগড়াছড়ি জেলা সাধারণ সম্পাদক উক্যনু মারমা নামে এক যুবক। আর এ অবরোধ সফল করতে এতে পূর্ণ সমর্থন ও সংহতি জানায় পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সহ তাদের অনুগত সহযোগী সংগঠনগুলো। অবরোধের নামে জেলা জুড়ে তাণ্ডব চালায় পিকেটাররা, যার রেশ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে।
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর