
কক্সবাজারের রামুর সেই রাতটির কথা আজও মানুষ শিউরে ওঠে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে হঠাৎ গুজব ছড়িয়ে পড়ে—ফেসবুকে এক তরুণ নাকি কোরআন অবমাননা করেছে। মুহূর্তেই জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে। শতবর্ষের সম্প্রীতির গ্রাম রামু নিমিষেই পরিণত হয় বিভীষিকাময় অগ্নিকুণ্ডে। রাতভর হামলায় জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায় ১২টি বৌদ্ধবিহার ও ২৬টি বৌদ্ধঘর। পরদিন অগ্নিসংযোগ ছড়িয়ে পড়ে উখিয়া-টেকনাফেও; ভস্মীভূত হয় আরও সাতটি বিহার।
সেই ভয়াল রাতের পর কেটে গেছে ১৩ বছর। ভেঙে পড়া বিহারগুলো আবার দাঁড়িয়ে গেছে নতুন রূপে, চারপাশে ফিরেছে সৌন্দর্য। বহিরঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধন আগের মতো হলেও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বুকের ক্ষত এখনও শুকোয়নি। কারণ, সেই ঘটনায় দায়ের হওয়া ১৯ মামলার একটিরও বিচার হয়নি আজও।
রামু, উখিয়া ও টেকনাফে মোট ১৯টি মামলা দায়ের হয়েছিল। এর মধ্যে একটি বাদ পড়লেও বর্তমানে ১৮টি মামলা বিচারাধীন। প্রায় ৯০০ জন আসামি আর ১৬০ জন সাক্ষী থাকলেও সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। সমন জারি হলেও নিরাপত্তাহীনতা আর শঙ্কায় অনেকে মুখ খুলতে অনীহা প্রকাশ করছেন। ফলে মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে আছে। কয়েকটি মামলা বর্তমানে পিবিআই-এর পুনঃতদন্তাধীন।
অভিযোগ আছে, মামলার বাদী হয়েছে পুলিশ, তদন্তও করেছে পুলিশ। তাই অনেককে ইচ্ছেমতো আসামি করা হয়েছে, আবার প্রকৃত হামলাকারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। চিত্র-ভিডিওতে ধরা পড়া অনেক অপরাধী চার্জশিট থেকে নাম কাটিয়ে গেছে।
জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ফোরামের সদস্যসচিব মিথুন বড়ুয়া বোথাম বলেন, "বিহারগুলো নতুন রূপে দাঁড়ালেও বুকের ভেতরের রক্তক্ষরণ থামেনি। মামলাগুলো রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীরা বাদ পড়েছে, দায়ীদের আড়াল করা হয়েছে। বিচারহীনতার কারণে তারা এখন বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছে।"
রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়ুয়ার মতে, "যারা ওই রাতে হামলা চালিয়েছে, তারা কোনো ধর্মের মানুষই হতে পারে না। কিন্তু বিচার না হওয়ায় আমাদের মনে ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। আগের সরকার ব্যর্থ হয়েছে, এখনও কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। পুনঃতদন্ত করে দ্রুত বিচার চাই।"
রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, "২০১২ সালের সেই হামলা গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। অথচ এত বছরেও একটি মামলারও বিচার হয়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক। দোষীরা শাস্তি না পেলে আবারও এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে পারে।"
রামুর স্থানীয় বাসিন্দা সাজু বড়ুয়ার অভিযোগ, মামলায় চেনা-অচেনা অনেককে জড়ানো হলেও অনেক প্রকৃত অপরাধী আড়ালে গেছে। আর এ কারণেই সাক্ষীরা আদালতে যেতে চান না।
কিছু সাক্ষী আবার বলেন, তারা পরিবার নিয়ে এলাকায় বাস করেন। নতুন করে সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কিংবা নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে তারা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
রামু উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি রিটন বড়ুয়া মনে করিয়ে দেন, "ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, অনেকে চার্জশিট থেকে বাদ গেছে। আবার নিরপরাধরা আসামি হয়েছে। তাই সাক্ষীরা আদালতে যেতে চান না। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদেরও তো চিন্তা আছে।"
তার মতে, "১৩ বছর পার হয়ে গেলেও রামুর সেই ভয়াল রাতের ক্ষত আজও শুকায়নি। নতুন বিহার দাঁড়ালেও ভেতরের রক্তক্ষরণ থেমে নেই। মামলা ঝুলে আছে, সাক্ষীরা মুখ খুলছে না, আর অপরাধীরা পার পেয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।"
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ১৮টি মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। তবে প্রতিটি মামলার হালখবর কেবল সংশ্লিষ্ট আদালতের আইন কর্মকর্তারাই জানেন। সাবেক পিপি আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান ও ফরিদুল আলমও জানিয়েছেন, সাক্ষীর অভাবে বিচার এগোচ্ছে না।
এবারের ২৯ সেপ্টেম্বরকে ঘিরে বৌদ্ধ সম্প্রদায় নানা কর্মসূচি আয়োজন করেছে—সকালে উপাসনা, অষ্টশীল গ্রহণ, পতাকা উত্তোলন, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। তবে নিরাপত্তার কারণে এবার র্যা লি থাকছে না।
সবকিছুর সূত্রপাত হয়েছিল উত্তম বড়ুয়া নামে এক তরুণকে ঘিরে—যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি নাকি ফেসবুকে কোরআন অবমাননা করেছেন। পরে জানা যায় সেটি ছিল গুজব। কিন্তু এই গুজবই রাতারাতি পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় শতবর্ষের সম্প্রীতির প্রতীক বৌদ্ধপল্লীগুলো।
ঘটনার পর থেকে উত্তম বড়ুয়ার খোঁজ মেলেনি। তার বাবা-মা এখনও অপেক্ষা করছেন—একদিন হয়তো ছেলে ফিরে আসবে।
কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, "শত বছরের ধর্মীয় সম্প্রীতি মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আজও অপরাধীরা বিচারের মুখোমুখি হয়নি। তবে আমরা আশাবাদী—রামুতে পুরোনো সম্প্রীতির বন্ধন আবারও দৃঢ় হয়েছে।"
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর