
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার ভূয়াই গ্রামে একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দিরে যুগ যুগ ধরে পাশাপাশিভাবে ধর্মীয় উপাসনা চলছে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
একপাশে মন্দিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূজা-অর্চনা করছেন, অন্যপাশে মসজিদে মুসলমানরা নামাজ আদায় করছেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। ভূয়াই দুর্গা মণ্ডপে পূজা উদযাপনের দৃশ্যটা তাই একটু অন্যরকম।
এখানকার ভূয়াই জামে মসজিদ এবং ভূয়াই দুর্গামণ্ডপ একই আঙিনায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
একই আঙিনায় অবস্থিত মসজিদে ভোরে ফজরের আজানের পর মুসল্লিরা নামাজ আদায় করে চলে যান। এরপর সকাল থেকেই মণ্ডপে শুরু হয় পূজা-অর্চনা। বহু বছর ধরে এমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে চলছে ভূয়াই জামে মসজিদ ও ভূয়াই দুর্গামণ্ডপ।
জানা গেছে, ভূয়াই বাজার দুর্গা মণ্ডপে মুসলমান ধর্মালম্বীদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়সূচী লাগানো রয়েছে। মূলত নামাজের সময়সূচী দেখেই পূজারীরা তাদের পূজা অর্চনা করে থাকেন। আজানের সময় থেকে নামাজের প্রথম জামাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের মাইক, ঢাক-ঢোলসহ যাবতীয় শব্দ বন্ধ রাখা হয়। নামাজের প্রথম জামাত শেষ হলে মন্দিরের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। এখানে কোনো বিশৃঙ্খলা হয় না। একই উঠানে দীর্ঘদিন ধরে উভয় ধর্মের মানুষ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন। উভয় ধর্মের মানুষজন ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে যার যার ধর্ম পালন করছেন।
আলাপকালে স্থানীয়রা জানান, জুড়ীতে ধর্মীয় সম্প্রীতির এটি একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। এখানে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ আছেন দুই ধর্মের মানুষ। ধর্মীয় উৎসব পালনে কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না বরং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি তাদের জন্য অনেক বড় গর্বের বিষয়।
ভূয়াই জামে মসজিদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাকিম আহমদ বাবুল বলেন, “এখানে কোনো ধরনের বিভেদ ও ঝামেলা ছাড়াই হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা যার যার ধর্ম পালন করে আসছেন। দুর্গাপূজার সময়েও ঢাক-ঢোল নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। মসজিদ ও মণ্ডপ কমিটি সমন্বয় করে যার যার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেন।”
ভূয়াই জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা সিরাজ উদ্দিন বলেন, “আমি ১৯ বছর যাবত এই মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমাদের এখানে একই উঠানে দুইটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে মুসলমান এবং হিন্দুরা যে যার ধর্ম সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন। আমরা নামাজ পড়ছি, তারা পূজা করছেন। কেউ কারো ধর্মে কোনো হস্তক্ষেপ করছেন না। আমাদের মাঝে ধর্মীয় আচার-বিধি পালন করা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই অনেক বছর ধরে চলছে এ সম্প্রীতির বন্ধন।”
ভূয়াই জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক মাসুক আহমদ বলেন, “এখানে যুগ যুগ ধরে আমরা ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে চলছি। আমাদের এখানে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।”
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান চুনু বলেন, “ভূয়াই বাজার সার্বজনীন পূজা মণ্ডপে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে মসজিদ ও মন্দিরে মুসলমান ও হিন্দুরা যার যার ধর্ম পালন করে আসছে। এখানকার মসজিদ ও মন্দিরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখতে বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষজন ছুটে আসে।”
ভূয়াই পূজা মণ্ডপের সাধারণ সম্পাদক প্রণয় দাশ ও সভাপতি পীযুষ কান্তি দাস বলেন, “এখানে একটি টেবিলে নামাজের সময়সূচি রাখা আছে। নামাজের শুরু ও শেষ দেখে আমরা আমাদের পূজা উদযাপন করি। নামাজে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য আমরা সর্বদা সচেষ্ট আছি। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কোনো ধরনের বিভেদ নেই। আমরা মিলেমিশে যার যার ধর্ম পালন করছি।”
জুড়ী থানার ওসি মো. মুরশেদুল আলম ভূঁইয়া বলেন, “এখানে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ আছেন দুই ধর্মের মানুষ।”
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাবলু সূত্র ধর জানান, “উপজেলার ভূয়াই বাজারে একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির স্থাপিত হলেও প্রত্যেক ধর্মের মানুষ নিজ-নিজ ধর্ম সম্প্রীতি বজায় রেখে পালন করে আসছে। এ এলাকার মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি বিদ্যমান রয়েছে। যার ফলে নামাজ ও পূজা পালনের ক্ষেত্রে কখনও সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। আমরা আশা করি বিগত বছরের ন্যায় এ বছরও সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পূজা উদযাপিত হবে।”
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জুড়ী উপজেলার ভূয়াই সার্বজনীন পূজা মণ্ডপ। এখানে একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির অবস্থান করায় একপাশে মন্দিরে হিন্দু ধর্মের মানুষ পূজা-অর্চনা করছে, অন্যপাশে মসজিদে মুসলমানরা নামাজ পড়ছে। এভাবেই ধর্মীয় সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যুগ যুগ ধরে চলছে পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয়। এভাবেই সাম্প্রতিক সম্প্রীতি রক্ষা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা করছি।”
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন বলেন, “দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে এখানে সম্প্রীতি বজায় রেখে যার যার ধর্ম পালিত হচ্ছে, যা সামাজিক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছে। বিগত বছরের মতো এ বছরও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপিত হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখতে তৎপর আছে।”
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর