
সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) আরও জোরদার ও শক্ত ভূমিকা পালন করার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচনী সংলাপে অংশ নিয়ে তারা বলেন, কেবল আইন ও আইনের নির্দেশনা জারি করে ক্ষান্ত হলে চলবে না। স্বচ্ছতা দিয়ে ইসির কার্যক্রম চালাতে হবে। নির্বাচন কর্মকর্তাদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে এক সংলাপে এসব পরামর্শ দেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এই সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন, চার কমিশনার এবং নয়জন সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা ও একজন পর্যবেক্ষক অংশ নেন। সংলাপে অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জকরিয়া, নির্বাচন পর্যবেক্ষক মুনিরা খানম, সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা খন্দকার মিজানুর রহমান, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক যুগ্মসচিব মোহাম্মদ নুরুজ্জামান তালুকদার, সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মিহির সারোয়ার মোর্শেদ, ঢাকা জেলার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা শাহ আলম, সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ শাহজাহান, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক উপসচিব মেজবা উদ্দিন আহমেদ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক যুগ্মসচিব শাহেদ উন নবী চৌধুরী এবং সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার।
গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে করার জন্য সিইসিকে পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক মুনিরা খানম। তিনি বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের আলোচনা হচ্ছে। গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে করতে পারেন। আলাদা করলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। অনেকেই আলাদা চাইতে পারে। কিন্তু আপনারা চেষ্টা করুন একইসঙ্গে দুটো নির্বাচন করতে।”
মুনিরা খানম বলেন, স্বাধীনতার পর যেকোনো নির্বাচনেই পেশিশক্তির ক্ষমতা দেখা গেছে। “আমাদের নির্বাচন প্রায়ই করতে দিত না। মিছিল করতে গেলেই অপরপক্ষ থেকে এসে হামলা করত। এটা এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। বাংলাদেশে ভোট কারচুপি হয়েছে, ব্যালট ছিনতাই হয়েছে, এমন কিছু নেই যে সেটা হয়নি।”
নির্বাচন যদি সঠিক না হয় তাহলে সংবিধানে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না উল্লেখ করে মুনিরা খানম বলেন, “নির্বাচন কমিশনের যারা কাজ করেন, তাঁরা দেশের গণতন্ত্রের প্রধান চালিকাশক্তি।”
“সমগ্র জাতি আপনাদের ওপর নির্ভর করছে যে এই নির্বাচনটা কীভাবে আপনারা সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ করতে পারেন। এখন আপনাদের ক্যারিশমা দিয়ে, আপনাদের ট্রান্সপারেন্সি দিয়ে, আপনাদের কার্যক্রম দিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ একটা নির্বাচন করতে হবে।”
তফসিলের আগেই আচরণবিধি পর্যবেক্ষণে রাখার পরামর্শ দিয়ে সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার বলেন, “এখনই বিভিন্ন দল, ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। এটি ইসি একটি কমিটি করে মনিটর করে যা তফসিলের পরে হয়। এটাকে নির্বাচনের আগে থেকে মনিটর করা যায় কি না। মনিটর করতে পারলে নির্বাচনী পরিবেশ ভালো থাকে এবং নির্বাচনী কার্যক্রমও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।”
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন মাহফুজা আক্তার। তিনি বলেন, “এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবার জন্য আমি কমিশনকে অনুরোধ করব। যাতে আমরা মাঠে আচরণবিধিমালা সেভাবে পরিচালনা করতে পারি।”
মাহফুজা আক্তার বলেন, “নির্বাচন কমিশন যদি অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাচনী দায়িত্বগুলো প্রত্যেকের মধ্যে সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে দেয় এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়, তাহলে মনে হয় ভালো হয়। অনেক সময় দেখা যায়, রিটার্নিং অফিসার নির্বাচনী দায়িত্ব পরিচালনা করতে গিয়ে কার্যত তার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারেন না। এই জিনিসগুলো আমাদের একটু জরুরি দেখা দরকার। এই জিনিসগুলো নিশ্চিত করতে পারলে নির্বাচন আরেকটু সুষ্ঠুভাবে করা যেতে পারে।”
মাহফুজা আক্তার বলেন, “নির্বাচন কমিশনেরও আরও জোরদার ও শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু আইন করে দিয়ে আর আইনের নির্দেশনা জারি করে দিয়ে ক্ষান্ত হলে হবে না। আমাদের নিজস্ব কর্মকর্তাদেরকে সেটা পরিচালনা করার বিষয়ে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।”
সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা খন্দকার মিজানুর রহমান বলেন, “আমাদের আরপিও-তে আছে সহকারী রিটার্নিং অফিসার একের অধিক কনস্টিটিউন্সিতে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। কিন্তু রিটার্নিং অফিসার একাধিক নির্বাচনী এলাকায় থাকতে পারবেন। এক্ষেত্রে ছোট জেলায় খুব বেশি সমস্যা হয় না। কিন্তু বড় এলাকায় সমস্যা হয়। তাই আমার মনে হয়, নির্বাচন কমিশনার যদি মনে করেন, তাহলে যেখানে নির্বাচনী এলাকা বেশি, সেখানে একটি জেলায় একাধিক রিটার্নিং অফিসার রাখতে পারেন। কারণ যেখানে নির্বাচনী এলাকা দুইটা তিনটার বেশি, সেখানে একজন রিটার্নিং অফিসারের মনিটর করা কঠিন। তাই যদি রিটার্নিং অফিসার বেশি থাকে, তাহলে আমার মনে হয় তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা সহজ হবে।”
আচরণবিধি নিয়ে খন্দকার মিজানুর রহমান বলেন, “যেকোনোভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। কোনো ব্যত্যয় নির্বাচন কমিশন প্রশ্রয় দেবে না। তাহলে কমিশনের কাজ অনেক সহজ হবে। যদি কমিশন প্রথমেই ঢিলা দেন, তাহলে হবে না। প্রথম থেকেই শক্ত থাকতে হবে। আর যথাযথ শাস্তি দিতে হবে আচরণবিধি ভঙ্গকারীকে। শোকজ করে কাজ হবে না, শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে।”
জাতীয় নির্বাচন করতে প্রায় ১০ লাখ লোকবল দরকার উল্লেখ করে সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জকরিয়া বলেন, “নির্বাচন কমিশনের লোকবল আড়াই হাজার। ইসির বাইরে সরকারি, বেসরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে লোকবল নিয়োগ করা হয়। এসব লোকবল নিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বেসরকারি পর্যায়ে এমন প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো দলীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন ইসলামী ব্যাংকসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি মাথায় রেখে লোকবল নিয়োগ করতে হবে। বিগত তিন নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের নিয়োগে এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে।”
তিনি বলেন, “গত ১৭ বছরে দেওয়া অস্ত্র ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। সীমান্ত দিয়ে আসা নকল টাকা, সন্ত্রাসী, মাদক প্রবেশ বন্ধের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এটা করতে হবে। সন্ত্রাস দমন ও সন্ত্রাসীদের কার্যকরভাবে আইনের আওতায় আনা, কালো টাকা, অর্থ পাচারকারী ও ঋণখেলাপিদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তরের বেসামরিক প্রশাসনকে নিরপেক্ষ নিশ্চিত করতে হবে।”
ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া, কম সংখ্যক ভোটার নিয়ে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের পরামর্শ দেন তিনি।
ভোটকেন্দ্র পাহারা কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়ে ড. জকরিয়া বলেন, “স্থানীয় নির্দলীয় বয়স্ক লোকদের নিয়ে এ ধরনের কমিটি করা গেলে প্রত্যেকে প্রত্যেককে চিনতে পারবে এবং জালভোট দেওয়া, অন্যায় আচরণ করা, নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করা অনেকটা কমে আসবে।”
সাত জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইসির সাবেক উপসচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, “পোস্টার ব্যবহার যত্রতত্র হচ্ছে, এখনই এটা বন্ধ করতে হবে। প্রতি ইউনিয়নে আচরণবিধি প্রতিপালন যদি এখনই করা যায়, তাহলে নির্বাচন অনেকটা সহজ হবে।”
সমাপনী বক্তব্যে গত তিন নির্বাচনের ভোটের দায়িত্বে থাকাদের সকলকে বাদ না দেওয়ার যুক্তি তুলে ধরে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, “১০ লাখ লোকের মধ্যে বাদ দিতে গেলে কম্বলই উজাড় হবে। লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড়—আমার অবস্থা হয়েছে সে রকম।”
সিইসি বলেন, “গত তিনটা নির্বাচনে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের নিয়ে সবাই তো সন্দেহ পোষণ করে। তবে ভালো-খারাপ তো সবখানেই আছে। কিন্তু একদম অনেকে বলছেন, গত তিন নির্বাচনে যারা কাজ করেছেন, তারা যেন ধারে-কাছে না আসতে পারে। এখন ১০ লাখ লোকের (ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে সাধারণত) মধ্যে বাদ দিতে গেলে, কম্বলই উজাড়। লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড়—আমার অবস্থা হয়েছে সে রকম।”
এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, “সুতরাং তাদের কিছু নিতে হবে। তবে তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হবে। মানুষ তো মানুষই। বিবেক আছে তো।”
সিইসি বলেন, “আমরা ব্যাংক থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নেওয়ার কথা বলছি। আমাদের কাছে নানা কারণে অভিযোগ আসছে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার বিষয়ে। আমরা বিষয়টি লক্ষ্য রাখব। যা করার আমরা করব মোটামুটি।”
সিইসি বলেন, “দলীয় দলদাসের মতো কাজ করতে পারবেন না—সেটা আমরা নিশ্চিত করব। কারও যদি রাজনৈতিক অভিলাষ থাকেও, সেটা বাস্তব কাজে প্রতিফলিত হবে না, সেটা আমরা নিশ্চিত করব। কোনো পক্ষে কাজ করলে অ্যাকশন হবে। এখন কারও পক্ষে কাজ করলে অ্যাকশন হবে।”
নির্বাচন করার দায়িত্ব তো কেবল ইসির নয় উল্লেখ করে সিইসি বলেন, “এটা জাতীয় দায়িত্ব। ভোটের সময় ইসির ক্ষমতা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা পান। আগে তো রাতে গিয়ে মোটিভেটেড করে কায়দা করে ভোটটা আদায় করে নেওয়া হয়েছে। এখন যত রকমের কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব আমরা নেব, যাতে দলীয় আচরণ না করতে পারে।”
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জাতীয় এর সর্বশেষ খবর