
আব্দুল আজিজ, একদিকে সেন্টমার্টিনের বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির কর্মী, অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের আউটসোর্সিং স্টাফ। সরকারি পদবির আড়ালে তার আসল পরিচয় একটাই- তিনি রোহিঙ্গা।
স্থানীয় দালালচক্রের সহায়তায় জাল কাগজে তৈরি করেছেন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), পেয়েছেন সরকারি চাকরি। এখন দ্বীপে ঘুরছেন সরকারি কর্মীর বেশে, অথচ রাষ্ট্রের চোখে তিনি শরণার্থী।
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আজিজ বর্তমানে সেন্টমার্টিন বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির কর্মী। পাশাপাশি তিনি জেলা পরিবেশ অধিদফতরের অধীনে মেরিন পার্কে চুক্তিভিত্তিক আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
স্থানীয় সূত্র ও নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, আজিজ মূলত মিয়ানমারের নাগরিক মো. আব্দুলের ছেলে। ১৯৯২ সালে আব্দুল তার স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন এবং সেন্টমার্টিনে আশ্রয় নেন। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হলে তখন আজিজের বয়স মাত্র ছয় বছর। পরের বছরই আজিজের মা নুর নাহারকে বিয়ে করেন স্থানীয় বাসিন্দা আলী আহমদ।
২০১৭ সালে আজিজ জন্মনিবন্ধনে আলী আহমদকে বাবা ও নুর নাহারকে মা হিসেবে দেখিয়ে বাংলাদেশি পরিচয়ে এনআইডি তৈরি করেন। জন্মসাল দেখানো হয় ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি- যে বছর তার আসল বাবা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন, তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা ও জাল।
আলী আহমদ নিজেও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আজিজ আমার ছেলে নয়। তার বাবা ছিলেন মিয়ানমারের আব্দুল। দালাল চক্র আমাকে বাবা বানিয়ে এনআইডি করেছে বলে শুনেছি।’
স্থানীয়দের দাবি, আজিজকে এই এনআইডি করতে সহায়তা করেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুর রউফ। যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কোনও সহযোগিতা করিনি। হয়তো দালালদের মাধ্যমে টাকা দিয়ে এনআইডি করেছে।’
কোনপাড়া এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, আজিজ রোহিঙ্গা হলেও স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে এনআইডি ও সরকারি চাকরি দুটোই জোগাড় করেছে।
দ্বীপের স্থানীয় এক যুবক নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, ‘এখানে অনেকে রোহিঙ্গা পরিচয় গোপন করে চাকরি করছে। আজিজ তাদের একজন। এখন সরকারি লোকের মতো ঘুরে বেড়ায়।’
সম্প্রতি গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে সেন্টমার্টিনের গলাচিপা থেকে দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ পায় এফএক্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেই কাজের সময় পরিবেশ অধিদফতরের কর্মীর পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি করেন আজিজ।
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক বসন্ত দে জানান, ‘সে এসে বলে- সমস্যা করব না, তবে পরিবেশের পক্ষ থেকে সিমেন্ট, তেল আর ১০০ বস্তা বালু দিতে হবে। আমরা সময় চাইলে সে লোকজন নিয়ে এসে হুমকি দেয়।’
আজিজ একসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করায় ২০২২ সালের শেষ দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। পরে তিনি লিখিতভাবে অঙ্গীকার দেন যে আর পরিবেশ অধিদফতরে কাজ করবেন না। কিন্তু অল্প সময় পরই আবার সেই দফতরেই যুক্ত হন- যা সরকারি চাকরি বিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন।
যোগাযোগ করা হলে আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আমি কোনও চাঁদা দাবি করিনি। সঠিক কাগজপত্র দিয়েই এনআইডি করেছি। কিছু লোক ষড়যন্ত্র করছে।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, আলী আহমদ তার প্রকৃত বাবা নন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘ভুল তথ্য দিয়ে এনআইডি তৈরি করা অপরাধ। চাঁদা দাবির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা জানান, ‘আজিজ আমাদের আউটসোর্সিং কর্মী। সে রোহিঙ্গা- এমন অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিচয়ে এনআইডি তৈরি এবং চাঁদা দাবির অভিযোগ দুটোই গুরুতর। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর