
মাছের বংশবিস্তার, বেড়ে ওঠা ও টেকসই আহরণের স্বার্থে বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাস্তবে সেই নিষেধাজ্ঞা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। অভিনব কৌশলে এখনো সাগরে মাছ শিকার চলছে, আর এসব মাছ প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে কক্সসবাজারসহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হচ্ছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাস, কাভার্ডভ্যান, এমনকি ছোট মালবাহী ট্রাকেও বরফে মোড়ানো তাজা মাছ পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন বাজারে। এতে মাছের প্রজনন মৌসুমে সরকারের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সদরের খুরুশকুলের একাধিক ট্রলারমালিক প্রশাসনের নির্দিষ্ট মহলকে প্রতিটি ট্রলারের জন্য ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সাগরে যায়। ৫ সেপ্টেম্বর রাতে অন্তত ১৬টি ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরতে রওনা দেয় বলে দাবি করেছে সূত্রটি।
সূত্রের ভাষ্য- প্রতিবছরের মতো এবারও নিষেধাজ্ঞার শুরুতেই টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। যাদের ট্রলার আটক হয়, তারা পরে জরিমানা দিয়ে ছাড়িয়ে আনে। এতে কোনো মালিকেরই ভয় থাকে না।
ফিশারিঘাটের জেলেরা বলেন, প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত শতাধিক ট্রলার ঘাটে ভিড়ে। গভীর সাগর বা সাগরমোহনা থেকে আনা মাছ বরফে প্যাকেটজাত করে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান কিংবা যাত্রীবাহী বাসে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। এতে মূলত সাগরে ধরা মাছ নিষেধাজ্ঞার সময়ও নির্বিঘ্নে বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে।
খুরুশকুলের অন্তত ১০ জন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এবার তারা ‘নতুন কৌশলে’ সাগরে যাচ্ছেন। বড় ট্রলারগুলো দূরে নোঙর করে রেখে ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকায় তারা বরফ, খাবার ও বাজারসওদা সংগ্রহ করেন। এরপর রাতের আঁধারে সেই রসদ নিয়ে বড় ট্রলারে পৌঁছান। এতে কেউ সন্দেহ করে না, কারণ এসব ছোট নৌকা সাধারণত নদীতে মাছ ধরে।
ফিরে আসার সময়ও একই কৌশল- সাগর থেকে ধরা মাছ ছোট ট্রলারে করে ফিশারিঘাটে আনা হয়, যেখানে তা নদীর মাছ হিসেবে বিক্রি করা হয়। কেউ কেউ আবার চৌফলদণ্ডী ঘাটে গিয়ে সরাসরি মাছ বিক্রি করে।
এদিকে শুধুমাত্র সদরের খুরুশকুল থেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অন্তত ১২ থেকে ১৬টি মাছ ধরার ট্রলার বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এসব ট্রলারের মালিকদের মধ্যে আছেন ডেইল পাড়ার আব্দু শুক্কুর কোম্পানি, কাওয়ারপাড়ার জসিম উদ্দিন, রাস্তার পাড়ার নেজাম উদ্দিন, দিদার মিয়া, মনুপাড়ার মনির আহমেদ, পেচারঘোনার আমির হোসেন ও আমানুর।
কুতুবদিয়ার মৎস্য সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানান- এই আটজনসহ আরও কয়েকজন মালিকের ১১ টি ফিশিং ট্রলার জব্দ করেছে। শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরে অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ট্রলারগুলো জব্দ করে। প্রতিটি ট্রলার থেকে তিনজন করে জেলেকে আটক করা হয়। জব্দকৃত ট্রলারগুলো পরবর্তীতে কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
নৌবাহিনী বা কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
খুরুশকুলের স্থানীয় এক যুবক জানান, ট্রলার মালিক আব্দু শুক্কুর কোম্পানিকে বলতে শোনা গেছে- আমার দুইটা ট্রলারের একটা ধরা পড়ছে, কিন্তু আরেকটা বাঁশখালী আছে। সেই ট্রলার দিয়ে আজ রাতে ২০ লাখ টাকার জাল উঠিয়ে আনব। তিনি কোস্টগার্ডে তদবির চালাচ্ছেন বলেও এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে।
স্থানীয় জেলে আবদুল করিমের ভাষ্য, আমরা যারা সত্যি সত্যি ঘরে বসে আছি, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কিন্তু যারা টাকা দিয়ে সাগরে যাচ্ছে, তারা লাভবান হচ্ছে। এতে সরকার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, আমরাও হচ্ছি।
এ বিষয়ে ট্রলার মালিক নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘শুনেছি নৌবাহিনী কিছু ট্রলার ধরেছে, তবে আমার ট্রলার নয়। নিষেধাজ্ঞার সময় ট্রলার পাঠানো আমার দায়িত্ব না।’
অন্যদিকে ট্রলার মালিক জসিম উদ্দিনের দাবি, ‘বন্ধের আগে আমার ট্রলার গিয়েছিল, গতকাল রাতে ফিরে এসেছে। কিছু ট্রলার ধরা পড়েছে শুনেছি।’
খুরুশকুল বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কায়ছার আলম ১১টি ট্রলার জব্দের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের নিষেধ করেছি, কিন্তু কেউ শোনেনি। বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা দিয়ে সমুদ্রে গেছে। আজ ১১টি ট্রলার ধরা পড়েছে। নৌবাহিনী মাছগুলো নিলামে বিক্রি করেছে, দাম উঠেছে প্রায় ৩১ লাখ টাকা। ট্রলারগুলো কুতুবদিয়া ঘাটে রাখা আছে, পরে জরিমানা দিয়ে ছাড় পেতে পারে।’
কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যথোয়াইপ্রু মারমা বলেন, ‘১১টি ফিশিং ট্রলার থেকে ৭৬০ মন মাছ ও ৫০টি বেহুন্দি জাল জব্দ করা হয়েছে। মাছগুলো ১৪ লাখ ৯০ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি এবং ট্রলারগুলোকে তিন হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।’
জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির কয়েকজন সদস্য বলেন, ‘ইলিশের প্রজনন রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা সরকারের ভালো উদ্যোগ। আগে আরও বেশি দিনের নিষেধাজ্ঞা ছিল, আমরা আন্দোলন করে সময় কমিয়েছি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নিজেরাই সেই আইন মানছি না।’
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ইলিশ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ৩ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সাগর- নদীতে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু কক্সবাজারের খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডী, টেকনাফ ও বাহারছড়ায় অসাধু ট্রলার মালিকরা রীতিমতো সিন্ডিকেট গড়ে সাগরে ট্রলার পাঠাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা ও বংশবিস্তার নিশ্চিত করা। কিন্তু ঘুষ- দুর্নীতি ও প্রশাসনিক শৈথিল্যের কারণে এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে। জেলেদের জীবিকা রক্ষার নামে মালিকদের এই বেআইনি কার্যক্রমই মাছের প্রজনন ও মজুত হ্রাসের বড় কারণ।
তাদের মতে, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সমন্বয়হীনতা, ট্রলার মালিকদের প্রভাব, আর অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ- সব মিলিয়ে বঙ্গোপসাগরের ‘নিষিদ্ধ সময়’ এখন যেন কাগুজে নিয়মেই সীমাবদ্ধ। সরকার মা ইলিশ রক্ষায় যতই উদ্যোগ নিক না কেন, যদি এই দুর্নীতির জাল ছিন্ন না হয়, তবে ভবিষ্যতে সাগরে মাছ নয়, কেবল জালই পড়বে- খালি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা বলেন, ‘সাগরে আমাদের টিম অবস্থান করছে। কারা নিষেধাজ্ঞা ভেঙে মাছ ধরছে তা শনাক্তের চেষ্টা চলছে। কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সহায়তা করলে প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর