
ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে বিদায় জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। বৃষ্টি উপেক্ষা রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
শনিবার (১১ অক্টোবর) সকাল ১১ টায় জাতীয় কবিতা পরিষদের উদ্যোগে এই আয়োজন করা হয়। সেখানে দুপুর ১টা পর্যন্ত শ্রদ্ধা নিবেদন চলে।
শহীদ মিনারে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানান হাসান, অধ্যপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ফটো সাংবাদিক শহিদুল আলমসহ একাধিক অধ্যপক, লেখক, সাংবাদিক, কবি ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একাধিক ছাত্রছাত্রী।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই যে বিরল একজন মানুষ। তার মধ্যে কোন অহংকার করত না। আমরা তাকে বিষণ্ণ দেখিনি। হাটত সে। হাটা তার প্রিয় কাজ। আমাদের জন্য তার সাহিত্যকর্ম আমাদের পথ দেখাবে। আমাদের জন্য তার প্রস্থান ভীষণ ক্ষতির।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা তাকে ভালোবাসে। সাহিত্য সাথে যে সংযোগ তাও অনবদ্য। এরজন্য সে একুশে প্রদক সহ বেশ কয়েকটি পুরষ্কার ও পেয়েছে। এগুলো সবই তার প্রাপ্য ছিল।
বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তার ব্যক্তিগত অবস্থান স্পষ্ট ছিল। তবে ভিন্নমতকেও সম্মান করতেন। আমরা মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতি একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষককে হারালো। তিনি সব সময় মানুষের সম্মানের পাত্র হিসেবে থাকবেন।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আমি ফুলার রোডে স্যারের পাশের বাসায় থাকতাম। উনি দেখলেই এমন একটা মন জোড়ানো হাসি দিতেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, কারো আত্মা খুব পরিষ্কার না হলে, কারো হৃদয় খুব বিশুদ্ধ না হলে এভাবে হাসা যায় না। উনার হাসিটাই ছিল উনার একটা সিগনেচারের মত। স্যার অসম্ভব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, উনি প্রচন্ড জনপ্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন।
তিনি বলেন, উনাকে সবাই ভালোবাসতো। বিভিন্ন মত পথের মানুষ ভালোবাসতো। উনি যেটা বলেন, উনার নিজের বিবেক ও হৃদয়ের বিশ্বাস থেকে বলেন। উনি অনেক বড় লেখক ছিলেন। অনেক বড় চিত্র সমালোচক ছিলেন। তার মতো একটা মানুষ কেন আরও বেশি বছর বেঁচে থাকল না। উনার মৃত্যুতে আমাদের অনেক বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল।
বিশিষ্ট ব্যক্তি ছাড়াও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস, আর্কাইভ ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগ, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, কালী ও কলম প্রকাশনী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, ব্রাক ফ্যামেলি, এশিয়াটিক সোসাইটি, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, ছায়ানট, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ইন্সটিটিউট, বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ একাধিক রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন শ্রদ্ধা জানান।
এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে জানাযা শেষে মরদেহ দাফনের করা হয় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। এর আগে সকাল ১০ টায় তার মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হয়।
সেখানে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান, ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাজিন আজিজ চৌধুরী, ইংরেজি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, সংগীত বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ফুল দিয়ে মনজুরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এর আগে গত ৩ অক্টোবর অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম রাজধানীর ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) যাওয়ার পথে গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে গাড়িচালক একজনের সহায়তায় তাকে পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে নেন। সেখান থেকে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে মারা যান তিনি।
১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইয়েটসের কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব’ বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সর্বশেষ ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি ছিলেন একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক।
ছোটগল্পে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৭৪ সালে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিশাল মৃত্যু’ গল্পের মাধ্যমে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প’, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ এবং ‘সুখ ও দুঃখের গল্প’। উপন্যাসের মধ্যে ‘আজগুবি রাত’ ও ‘তিন পর্বেও জীবন’ পাঠকমহলে ব্যাপক প্রশংসা পায়। চিত্রকলা ও নন্দনতত্ত্ব নিয়েও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনা রয়েছে। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬) এবং একুশে পদক (২০১৮)।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর