
সিলেটের সাদা পাথরের পরে দেশব্যাপী আলোচনায় রয়েছে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর বালু লুটের তাণ্ডব। আদালতে দায়ের করা রিতের বিপরীতে যাদুকাটা নদীর দুটি বালু মহাল ইজারা বন্ধ ছিল কয়েক মাস। গত ৫ আগস্টের পর স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সম্পৃক্ততায় এবং জেলা প্রশাসকের সহায়তায় সেটি চালু করা হয়। ইজারা গ্রহনের পর সেখানে চলছে বালু লুটের মচ্ছব। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত দুই বিএনপি নেতার নাম দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় থাকার বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকা। এছাড়া এদের একজনের বিরুদ্ধে সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এমপিদের ছত্রছায়ায়া থাকা সাবেক বিএনপি নেতাদের দলে পুনর্বাসদন চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে। স্থানীয় বিএনপির বড় একটি অংশের দাবি, আগেই মাঠ গুছিয়ে বসে থাকা জামায়েতের বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে এর চরম মূল্য দিতে হতে পারে দলকে। বিগত সরকারের সময় প্রকাশ্যে আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় থেকে স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতা সাবেক এমপি রতন-রঞ্জিতের সঙ্গে মিলে সুবিধা নিয়েছে। পট পরিবর্তনের পর নিজেরা হয়েছেন ত্যাগী নেতা। আর নিজেদের সভা-সমাবেশে ও কমিটিতে ঠাঁই দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ এবং এর ব্যানারে থাকা বিএনপির সাবেক ও বিতর্কিত নেতাদের। জুলাই অভ্যুত্থানের হত্যাকারী হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে একই মামলার এজহারভুক্ত আসামিকে সঙ্গী করে বালু মহালের ইজারা নিয়েছেন তারা। এখন চালাচ্ছেন তাণ্ডব। নির্বাচনকে সামনে রেখে সুনামগঞ্জে বিএনপির প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা নষ্টের পেছনে দায়িদের ব্যাপারে এভাবেই মন্তব্য করেছেন দলটির একাধিক তৃণমূল নেতা ও স্থানীয় সচেতন মহলের সদস্যরা। তারা বলেন, আনিসুল ও কামরুল এবং তাদের ঘনিষ্ট সহযোগী নাসির মিয়াসহ একাধিক বিএনপি নেতাকর্মী যাদুকাটা ধ্বংসে জড়িত। কামরুল অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে এলেও কৌশলী আনিসুল থাকেন পর্দার আড়ালে। তবে মাস কয়েক আগের ঘটনায় আওয়ামী লীগের দাসত্বকারী সাবেক বিএনপি নেতাদের পুনর্বাসনে আনিসুলের ভূমিকা প্রকাশ্যে আসে। এ নিয়ে দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। যাদুকাটা পরিস্থিতির সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায় বিএনপির এই দুই মনোনয়ন প্রতায়শী নেতা এবং তাদের সহযোগীদের সম্পৃক্ততায় যাদুমহাল ২ এর ইজারা নিয়েছেন শাহ রুবেল নামে এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। শাহ রুবেল শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা একটি মামলার এজহারভুক্ত আসামি। অপরটি নিয়েছে বিএনপি নেতা নাসির। তিনি বিএনপি নেতা কামরুলের একনিষ্ঠজন। এর আগে এ বিষয়ে জানতে বিএনপি নেতা কামরুজ্জামান কামরুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ইজারাদার রুবেলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে যাদুকাটা ১ এর ইজারাদার নাসির আমার ঘনিষ্ট লোক।‘ স্থানীয়দের প্রশ্ন, কামরুলের ঘনিষ্ট লোক নাসিরই কেন রুবেলের পক্ষে যাদুকাটা ২ এর দায়িত্ব বুঝে নেন। দুজনেরই ঘইষ্ঠজন এই নাসিরই কি তবে কামরুল-রুবেলের মধ্যবর্তী সংযোগ লাইন? অপরদিকে স্থানীয় সচেতন মহলের বেশ কয়েকজন সদস্য বলছেন, প্রশাসনের অভিযান, বিজিবির বাধা এবং সরকারের শীর্ষ মহলের হস্তক্ষেপ- সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ১ ও ২ বালুমহাল ইজারা এবং এর পরবর্তী সব পর্যায়ের সমস্ত নির্দেশনা উপেক্ষা করে বালু লুটের ভয়াবহ তাণ্ডব থামাতে ব্যর্থ। এরইমধ্যে নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলনের বেপরোয়া কান্ডে চরম ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। বিএনপির যে সব চিহ্নিত নেতা ও তাদের সহযোগীরা একাজে সম্পৃক্ত দল কেন তাদের লাগাম টানছে না। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে পর্যায়ক্রমে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেই। বিএনপির দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় নাম রয়েছে তাদের। সেক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েই এমন বেপরোয়া বিএনপির ওই সব বিতর্কিত নেতারা। এদিকে চলমান এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আইনি লড়াই লড়তে থাকা স্থানীয় বাসিন্দা খোরশেদ আলম প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকার কথা জানিয়েছেন তিনি নিজেই। শুধু তাই নয়, যাদুকাটার নিয়ে অনুসন্ধানি প্রতিবেদনের কাজ করতে থাকা দেশের শীর্ষ একটি সংবাদপত্রে কর্তব্যরত এক সাংবাদিকের ব্যাপারেও দেওয়া হয়েছে প্রচ্ছন্ন হুমকি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, তার একার এই লড়াই দেখে ওই সাংবাদিক যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি এমন সব তথ্য বের করে এনেছিলেন যা অত্যন্ত জরুরি। আমাকে চাপে রাখার পাশাপাশি তার ব্যাপারেও শক্ত ভাষায় সতর্ক করা হয়েছে। তাকে জানিয়েছি বিষয়টি।' খোরশেদ আলম বলেন, একা এত বড় অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব জেনেও লড়ছেন তিনি। বরং যাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন তারা যখন এমপি মন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় বসবেন, তখন যাদুকাটা বাঁচাতে যাওয়ার অপরাধে কি শাস্তি পান তাই ভাবছেন। তিনি আতঙ্কিত। তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সম্পৃক্তদের ব্যাপারে ওই সাংবাদিককে তথ্য দিয়ে রেখেছেন। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে পরিচিয় প্রকাশ না করার শর্তে ওই সাংবাদিক বলেন, 'কোনো কিছুই যাদুকাটার ধ্বংস থামাতে পারছে না। বালুখেকোরা কি প্রশাসন আর সরকারের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেল? তারেক রহমান ৩১ দফা দিয়ে দেশ কাঁপাচ্ছেন আর তার লোকেরা সেটার দফারফা করে দিচ্ছে। দল এটা দেখে না? কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অভিযোগও গেছে তাদের ব্যাপারে। তাদের নেতাকর্মীরাই জানিয়েছেন। কোনো পদক্ষেপ নেই কেন? যাদুকাটা বা তার পাড়ের মানুষদের কথা বাদলই দিলাম। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রে বসে কেউ তারেক রহমান এবং বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে কিনা, সেটা দেখা উচিত। নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতিতে এধরণের কিছু অস্বাভবাইক নয়।' প্রকাশ্যে এসব ব্যাপারে অভিযোগ করছেন না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কার কাছে অভিযোগ দেবেন? সেটাই খুঁজে পাচ্ছেন না। সেটা নিশ্চিত না হয়ে প্রকাশ্যে আসলে তার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিক হত্যা এবং তাদের অপর হামলার ঘটনা তুলে ধরে তিনি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। সরাসরি যেহেতু তাকে হুমকি দেওয়া হয়নি, তাই তেমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, দিলেও নিতেন না। সামনে নির্বাচন এ সময় কোনো পক্ষের রাজনৈতিক চালের অংশ হতে চান না। দল হিসেবে বিএনপি যদি ওই নেতাদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ না নেয় এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দেয়, তাহলে অবশ্যই তিনি পদক্ষেপ নেবেন। এদেশে যেন আর কখনো কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান যেন না ঘটে, সেটা বিএনপি বার বার বলছে। দেখা যাক নিজেদের ভেতর থেকে সেটা দমন করতে সফল হয় কিনা। তারেক রহমানের ৩১ দফা আর এই সব নেতারা এক সঙ্গে বিএনপির মোর্চায় থাকতে পারে না। সেটা মানুষের কাছে ভয়াবহ প্রহসন হিসেবে দৃশ্যমান হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ভূমি দপ্তর নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সাড়া দিয়েছে। , জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরিবেশ উপদেষ্টার কাছে সংশ্লিষ্ট পর্যায় থেকে পাওয়া বক্তব্য ও গুরুত্বঊর্ণ তথ্য পাঠিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের সম্পৃক্ততার প্রমাণও আছে। সাদা পাথর এবং এই যাদুকাটাকাণ্ড আগামী নির্বাচনে বিএনপির ভোট ব্যাংকে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর