
কক্সবাজারের দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ ও আলোচিত দালাল মাহমুদুল করিম অবশেষে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। সোমবার (৩০ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ শহর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ জানায়, মাহমুদুল করিম দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার শহর ও আশপাশের এলাকায় জমি দখল, দালালি, প্রতারণা ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে একাধিক লিখিত অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ নানা অপকর্মের একাধিক মামলা রহয়েছে।
দুবাই প্রবাসী নিয়ামত উল্লাহ বাদী হয়ে দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলার ভিত্তিতেই এ অভিযান চালায় পুলিশ। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রবাসীর ক্রয়কৃত জমিতে প্রবেশ করতে গেলে মাহমুদুল করিমের নেতৃত্বাধীন চক্র কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে এবং জমিতে যেতে বাধা দেয়।
এদিকে মাহমুদুল করিমের গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই কক্সবাজারজুড়ে স্বস্তির হাওয়া বইছে। বহু ভুক্তভোগী শুকরিয়া আদায় করেছেন, কেউ আনন্দে কেঁদেছেন- আবার কেউ বলছেন, অবশেষে ন্যায়বিচারের শুরু হলো।
ভুক্তভোগীদের মতে, এবার যদি প্রশাসন কঠোর থাকে, তাহলে হয়তো অন্য চক্রগুলোর দৌরাত্ম্যও কমবে।
প্রবাসী নিয়ামত উল্লাহ বলেন, মাসের পর মাস আমরা ভয় আর অন্যায়ের মধ্যে ছিলাম। মনে হতো কেউই এই চাঁদাবাজদের থামাতে পারবে না। তার গ্রেপ্তারের খবর শুনে বুকটা হালকা হয়ে গেছে- এটা আল্লাহর রহমত।
তার ভাই আমিন উল্লাহ বলেন, এই মানুষটা আমাদের কাছ থেকে বারবার টাকা নিয়েছে, আবার ভুয়া মালিক সাজিয়ে জমি দখল করতে চেয়েছে। আজ তাকে পুলিশ ধরেছে- এটা আমাদের কাছে ঈদের আনন্দের মতো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের দক্ষিণ আদর্শ গ্রামে প্রবাসীদের জমি দখল ও চাঁদাবাজি এখন এক ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন, তার ভাই ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নাছির উদ্দিন, মুন্না এবং কুখ্যাত দালাল মাহমুদুল করিম মিলে গড়ে তুলেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
এই চক্র প্রকাশ্যে কোটি টাকার চাঁদা দাবি করে, ভুয়া মালিক সাজিয়ে জমি দখল করে, আবার কখনো মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি চালায় বলে অভিযোগ আছে।
প্রবাসী নিয়ামত উল্লাহ জানান, তিনি ও তার ভাই আমিন উল্লাহ ২০২৫ সালের ২২ জুন রেজিস্ট্রি নম্বর ২৫২৬-এর কবলামূলে ফাতেমা বেগম ও নূরুল হকের কাছ থেকে ৮ শতক জমি ক্রয় করেন। পরে ওই জমির নতুন খতিয়ান (২৫-১১০৮৩৩)ও সৃজন হয়।
কিন্তু কিছুদিন পরই প্রভাবশালী এই চক্র জমিটি নিজেদের দাবি করে কোটি টাকার চাঁদা আদায়ের পাঁয়তারা শুরু করে। নিয়ামত উল্লাহ বলেন, প্রথমে তারা জমি কিনে দেওয়ার নাম করে টাকা নেয়, পরে ভুয়া মালিক সাজিয়ে আবার কোটি টাকার চাঁদা দাবি করে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি।
তার হাতে থাকা একাধিক অডিও বার্তায় শোনা যায়, চক্রের সদস্যরা সরাসরি টাকা দাবি করছে এবং না দিলে জমিতে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন প্রথমে প্রবাসী নিয়ামত উল্লাহকে নিয়ে যান এনা পরিবহনের জিএম আবু বক্কর ও এডভোকেট নুরুল হকের কাছে জমি ক্রয়ের জন্য। রেজিস্ট্রির পর দখল বুঝিয়ে দেওয়া হলেও পরদিনই মহিউদ্দিন জানায়, আমাদের ২৪ লাখ টাকা দেয়নি আবু বক্কর ও নুরুল হক, টাকা না দিলে এই জায়গায় আসতে পারবেন না।
এরপর তারা দিদার নামে একজনকে ‘ভুয়া মালিক’ বানিয়ে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা দাবি করে এবং আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা নেয়। পরে তদন্তে প্রতারণার বিষয়টি প্রমাণিত হলে দিদার গংয়ের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
জমির প্রাক্তন মালিক আবু বক্কর বলেন, মহিউদ্দিন গং জমি বিক্রির জন্য লোক এনেছিল, আমরা খরচও দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে তারা নতুন করে টাকা দাবি শুরু করে। এখন ভুয়া মালিক দেখিয়ে প্রতারণা চালাচ্ছে।
এডভোকেট নুরুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন ও মুন্না আমাদের জমির কেয়ারটেকার ছিল। পরে তারা ভুয়া কাগজ বানিয়ে কোটি টাকার চাঁদা দাবি করছে। এ চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে আলোচিত দালাল মাহমুদুল করিম। তাকে ডিস্টার্ব না করার জন্য আমি নিজে তিন লাখ টাকা দিয়েছি, এরপরও তারা আবার চাঁদা দাবি করেছে।
পিএমখালীর স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ করিম বলেন, মাহমুদুল করিমের নাম শুনলেই এলাকার মানুষ ভয়ে থাকত। জমির দালালি আর চাঁদাবাজিতে সে কক্সবাজারে এক ভয়ংকর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল। এখন মানুষ একটু হলেও স্বস্তি পেয়েছে।
আরেক ভুক্তভোগী নেজাম উদ্দিন বলেন, সে শুধু প্রবাসীদের নয়, স্থানীয়দেরও ব্ল্যাকমেইল করেছে। প্রশাসন এবার যদি কঠোর হয়, তাহলে হয়তো এই এলাকায় আবার শান্তি ফিরবে।
কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইলিয়াস খান বলেন, দুবাই প্রবাসী নিয়ামত উল্লাহর দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে মাহমুদুল করিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর