আলু উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা জয়পুরহাটে এবার উৎপাদন বেশি হওয়া এবং ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীরা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। জেলার ২১টি হিমাগারে এখনও মজুত রয়েছে ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ বস্তা আলু, যা গত মৌসুমের মোট মজুতের প্রায় ৪০ শতাংশ। এতে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। ভালো দামের আশায় হিমাগারে সংরক্ষিত এই আলু এখন তাদের জন্য "গলার কাঁটা" হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলার ২১টি হিমাগার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে হিমাগারে ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ বস্তা আলু মজুত রয়েছে। প্রতি বস্তায় গড়ে ৮৫০ টাকা লোকসান ধরলে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২০ কোটি টাকা। এর আগে, হিমাগার গেট থেকে বিক্রি হওয়া ২০ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৬ বস্তা আলুতে ১৮০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, সরকারিভাবে আলু কেনার কোনো উদ্যোগ না থাকায় তারা চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি নতুন আলু রোপণের সময় ঘনিয়ে এলেও পুরনো আলু এখনো হিমাগারে পড়ে আছে। হিমাগার কর্তৃপক্ষ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে হিমাগার খালি করার নির্দেশ দিলেও বর্তমান বাজারদরে আলু বিক্রি করলে প্রতি বস্তায় অন্তত ১০৫০-১০৭০ টাকা লোকসান হওয়ায় কেউই আলু তুলতে আগ্রহী নন।
সদর উপজেলার সোটাহার ধারকী গ্রামের কৃষক ফেরদৌস মোল্লা বলেন, "সার সিন্ডিকেট এবং সেচ সিন্ডিকেটের পাল্লায় পড়ে ঋণ করে ফসল ফলাই। কিন্তু ফসলের ন্যায্য দাম পাই না। সরকার আমাদের এই দুর্দশা দেখছে না।" কালাই উপজেলার আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের সুড়াইল গ্রামের আলু ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম আকন্দ বলেন, "ভালো দামের আশায় ৪ হাজার বস্তা আলু ৫৬ লাখ টাকায় কিনে হিমাগারে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন মাত্র ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। প্রায় ৫১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে, আমার সব সঞ্চয় শেষ।"
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে জেলায় ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১০ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছিল। এর মধ্যে ২ লাখ ৬ হাজার ৭১৬ মেট্রিক টন বা ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৬ বস্তা আলু ২১টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। বর্তমানে ৮২ হাজার ৮৩৯ মেট্রিক টন বা ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ বস্তা আলু এখনো হিমাগারে পড়ে আছে।
কালাই পৌরশহরের এম ইসরাত হিমাগারে শুধু লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। কালাই পৌরশহরের শিমুলতলী এলাকার আর বি স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের মালিক প্রদীপ কুমার প্রসাদ বলেন, "আমাদের হিমাগারে দুই লাখ ৬০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষিত ছিল। দেড় মাস আগেই এগুলো বের করার কথা ছিল, কিন্তু ব্যবসায়ীরা তুলতে পারছেন না। আলু তুললেই বড় ক্ষতি নিশ্চিত, তাই সবাই দ্বিধায় আছেন।"
ক্ষেতলাল উপজেলার কৃষ্ণনগর এলাকার আলু ব্যবসায়ী শাহাবুল ও কামরুজ্জামান জানান, উৎপাদন থেকে হিমাগারে সংরক্ষণ পর্যন্ত প্রতি কেজি আলুর খরচ পড়েছে ২৪-২৫ টাকা, অথচ এখন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৯-১০ টাকায়। এতে প্রতি কেজিতে ১৬ টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে। আরেক আলু ব্যবসায়ী মিঠু ফকির বলেন, "১২ হাজার বস্তা আলুর মধ্যে ১০ হাজার বস্তা বিক্রি করে প্রায় ৯০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।"
জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ এ কে এম সাদিকুল ইসলাম বলেন, "গত বছর আলুর চাহিদার চেয়েও উৎপাদন হয়েছে বেশি, তাই দামও কমেছে। সরকার ২২ টাকা কেজি দরে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করেছে, তবে বাজারে তা এখনো কার্যকর হয়নি। কার্যকর হলে কৃষকদের লোকসানের পরিমাণ কিছুটা কমতো।"
জয়পুরহাট কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, "উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। সরকারিভাবে আলু কেনার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত হলেও এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। রপ্তানি ও বিকল্প বাজার তৈরির চেষ্টা চলছে।"
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গত ৫ সেপ্টেম্বর আক্কেলপুর উপজেলা সফরে এসে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সরকারিভাবে আলু কেনা হবে এবং টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। তিনি হিমাগার গেটে কেজিপ্রতি ২২ টাকা দরে আলু কেনা ও রপ্তানির আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সেই আশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আলু বিক্রি নিয়ে স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর