আধুনিক যুগে ফ্যাশন, রুচি আর ব্যক্তিগত সাজসজ্জার প্রশ্নে মুসলিম পুরুষদের মনে একটি প্রশ্ন প্রায়ই জাগে। তাহলো পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার পরা কি ইসলামে বৈধ?
স্বর্ণালংকার ব্যবহারের বিষয়টি শুধু সৌন্দর্য বা স্টাইল নয়, বরং এটি বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আল্লাহর নির্দেশ মানার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ইসলাম পরিশুদ্ধতা, নম্রতা ও মর্যাদাকে গুরুত্ব দেয়, আর সেই ভিত্তিতেই ব্যক্তিগত সাজসজ্জার সীমা নির্ধারণ করেছে।
ইসলামে পুরুষের জন্য সোনা পরা নিষিদ্ধ
ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার পরা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, স্বর্ণ ও রেশম আমার উম্মতের নারীদের জন্য হালাল, আর পুরুষদের জন্য হারাম। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২০৯৫)।
ইসলামের চারটি মাযহাব হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি সবকটিতেই এই বিধান সর্বসম্মতভাবে গৃহীত।
এই নিষেধাজ্ঞা কোনো কল্পিত বিষয় নয়। ইতিহাসে স্বর্ণ ছিল ঐশ্বর্য ও অহংকারের প্রতীক। এটি অহংবোধ, আত্মগর্ব বা দম্ভ উসকে দিতে পারে, যা ইসলাম নিরুৎসাহিত করে।
ইসলাম পুরুষদের বিনয়ী, সরল ও সংযত থাকতে শেখায়। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন, পৃথিবীতে গর্বভরে চল না। নিশ্চয়ই তুমি কখনোই পৃথিবী চিরে ফেলতে পারবে না, পাহাড়ের উচ্চতায়ও পৌঁছতে পারবে না। (সুরা ইসরা, আয়াত : ৩৭)।
এই আয়াতকে অনেক আলেম ব্যক্তিগত পোশাক-আশাক ও সাজসজ্জার প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেন। উদ্দেশ্য একটাই অহংকার ও আত্মপ্রদর্শন থেকে দূরে থাকা।
বিনয় ও মর্যাদাই সাজসজ্জার মূল
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, সর্বোত্তম পুরুষ তারা, যারা পোশাকে ও চেহারায় সবচেয়ে বিনয়ী। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)।
এই হাদিস আমাদের শেখায়, বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় বরং চরিত্র ও বিনয়ই মুসলমানের আসল পরিচয়।
স্বর্ণ পরিহার করার মাধ্যমে পুরুষ নিজের মধ্যে আত্মসংযম, বিনয় ও আধ্যাত্মিক সচেতনতা গড়ে তোলে। ইসলামী দৃষ্টিতে সাজসজ্জা শুধু বাহ্যিক শোভা নয়, এটি চরিত্র ও নৈতিকতার প্রতিফলন।
পুরুষদের জন্য হালাল বিকল্প
স্বর্ণ পরা হারাম হলেও ইসলাম পুরুষদের জন্য অন্যান্য ধাতু ও পাথর ব্যবহার বৈধ করেছে। রুপা, প্লাটিনাম, টাইটানিয়াম, স্টেইনলেস স্টিল বা প্রাকৃতিক পাথর দিয়ে তৈরি অলংকার ব্যবহার করা যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও রুপার আংটি ব্যবহার করতেন। তাই রুপা মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্য ও মর্যাদাপূর্ণ বিকল্প।
বর্তমান সময়ের আধুনিক পুরুষরা রুপা বা টাইটানিয়ামের আংটি, ব্রেসলেট, কাফলিংকস ইত্যাদির মাধ্যমে রুচিশীলভাবে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে পারেন। প্লাটিনামের গয়না বা ঘড়ি উচ্চমান বজায় রেখেও ইসলামী নির্দেশনার মধ্যে থাকে।
তবে এ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য যেন শুধু সাজসজ্জা না হয়। কার্যকর জিনিস যেমন ঘড়ি বা ইলেকট্রনিক্সে সামান্য স্বর্ণ ব্যবহৃত হলে তাতে সমস্যা নেই, যতক্ষণ না তা বিলাসিতার প্রকাশ ঘটায়।
আধুনিক ফ্যাশনে ইসলামী ভারসাম্য
আজকের গ্লোবাল ফ্যাশন ট্রেন্ডে পুরুষদের জন্য স্বর্ণচেইন, আংটি বা ব্রেসলেট জনপ্রিয়। এতে অনেক তরুণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন যে ফ্যাশনের সঙ্গে ধর্মীয় বিধান কীভাবে মেলানো যায়?
ইসলাম এই প্রশ্নের সহজ উত্তর দিয়েছে, ফ্যাশন মানে অন্ধ অনুকরণ নয়, বরং রুচির সঙ্গে নৈতিকতার ভারসাম্য। মুসলিম পুরুষ চাইলে হালাল বিকল্প ব্যবহার করে আধুনিক স্টাইল বজায় রাখতে পারেন। রুপা, টাইটানিয়াম বা প্লাটিনামের গয়না, সংযত ডিজাইনের ঘড়ি কিংবা কাফলিংকস হতে পারে সেই পথ।
যদি কোনো ঘড়িতে সামান্য স্বর্ণের অংশ থাকে কিন্তু তা মূলত ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে হয়, তবে তা পরা যায়। উদ্দেশ্য যেন শৌখিনতা নয়, কার্যকারিতা হয়—এই হলো ইসলামি ভারসাম্যের শিক্ষা।
মনে রাখুন
ইসলামে পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার পরা নিষিদ্ধ হলেও নারীদের জন্য তা বৈধ। এই বিধানের মূলে রয়েছে বিনয়, সংযম ও অহংকার থেকে দূরে থাকা।
পুরুষ চাইলে রুপা, প্লাটিনাম, টাইটানিয়াম বা স্টেইনলেস স্টিলের অলংকারে নিজের রুচি প্রকাশ করতে পারেন। এতে যেমন আভিজাত্য বজায় থাকে, তেমনি ধর্মীয় সীমাও রক্ষা হয়।
আসলে এই বিধান কোনো সীমাবদ্ধতা জন্য নয়, বরং এটি এক আধ্যাত্মিক অনুশাসন, যা মানুষকে বাহ্যিক চাকচিক্যের পরিবর্তে অন্তর্নিহিত গুণাবলির দিকে মনোযোগ দিতে শেখায়। ইসলামের এই ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিই আধুনিক যুগেও মুসলমানদের জন্য পথপ্রদর্শক।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর