বাংলাদেশের মোবাইলফোন শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে NEIR (National Equipment Identity Register) ডাটাবেজ। এর লক্ষ্য দেশের মোবাইল খাতকে আরও স্বচ্ছ, সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ করা। তবে এই ইতিবাচক উদ্যোগের বিপরীতে একদল অসাধু ব্যবসায়ী ষড়যন্ত্রে নেমেছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বিদেশ থেকে ফোন এনে বিক্রি করে আসছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে আমদানি নির্ভরতার ফাঁদে ফেলে দেশীয় উৎপাদন শিল্পকে দুর্বল করা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে NEIR চালু করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইলফোন শনাক্ত করা এবং সেগুলোর নেটওয়ার্ক ব্যবহার বন্ধ করা। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়। শিল্পসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রভাবশালী আমদানিকারক ও অবৈধ ব্যবসায়ীদের চাপেই সেবার উদ্যোগটি বন্ধ হয়। ফলে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে অবৈধ মোবাইল ব্যবসায়ী চক্র এবং দেশে রিফার্বিশড ও গ্রে মার্কেট ফোনের বাণিজ্য ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়।
NEIR কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ:
NEIR হলো একটি জাতীয় ডাটাবেজ, যেখানে বৈধভাবে আমদানি বা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতিটি ফোনের IMEI নম্বর নিবন্ধিত থাকবে। এর মাধ্যমে টেলিকম অপারেটররা সহজেই শনাক্ত করতে পারবে কোন ফোন বৈধ, আর কোনটি অবৈধভাবে দেশে এসেছে। NEIR চালু হলে: ১. অবৈধভাবে আমদানি করা ফোন নেটওয়ার্কে কাজ করবে না। ২. সরকারের রাজস্ব ফাঁকি রোধ হবে। ৩. স্থানীয় মোবাইলফোন শিল্প সুরক্ষা পাবে। এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নয়, বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করার এক শক্তিশালী ঢাল।
অবৈধ ব্যবসায়ীদের অস্থিরতা ও অপপ্রচার:
NEIR বাস্তবায়নের খবর ছড়িয়ে পড়তেই আতঙ্কে পড়েছে অবৈধ ফোন ব্যবসায়ীরা। কারণ, এই ব্যবস্থার ফলে তাদের গ্রে মার্কেটের ফোন আর বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হবে না। তারা এখন বিভ্রান্তি ছড়ানোর নানা কৌশল নিয়েছে: ১. কেউ বলছে NEIR চালু হলে পুরনো ফোন বন্ধ হয়ে যাবে। ২. কেউ দাবি করছে বিদেশ থেকে আনা ফোন নিবন্ধন করা যাবে না। ৩. কেউ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করছে, এতে সাধারণ গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাস্তবে এসব কথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর। বিটিআরসি ইতিমধ্যেই জানিয়েছে—বৈধভাবে কেনা যেকোনো ফোন, এমনকি বিদেশ থেকে আনা ফোনও নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় নিবন্ধন করলেই সচল থাকবে। NEIR গ্রাহকের জন্য বাধা নয়; বরং এটি বৈধ গ্রাহকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ।
দেশীয় উৎপাদন বনাম অবৈধ আমদানি:
২০১৭ সালে বাংলাদেশে শুরু হয় স্থানীয়ভাবে মোবাইলফোন উৎপাদনের যুগ। বর্তমানে দেশে ১৭টিরও বেশি কারখানা রয়েছে, যেখানে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ২,৫০০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছেন। বাজারের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ ফোন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত। কিন্তু অবৈধ আমদানি চক্র এই সাফল্য মেনে নিতে পারছে না। তারা চায়, দেশীয় শিল্প দুর্বল হয়ে পড়ুক, যেন তারা আবার বিদেশি ফোন এনে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করতে পারে। তাদের স্বার্থরক্ষার এই প্রয়াসই NEIR বিরোধী ষড়যন্ত্রের মূল কারণ।
এখনই কেন NEIR অপরিহার্য:
১. অবৈধ ফোন আমদানির কারণে প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। NEIR এই ক্ষতি রোধ করবে।
২. বৈধ উৎপাদকদের টিকে থাকতে হলে বাজারে সমান প্রতিযোগিতা থাকা জরুরি। NEIR সেই ন্যায্য পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
৩. অবৈধ ফোনে নকল সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যার থাকার ঝুঁকি থাকে। NEIR এ ঝুঁকি কমিয়ে আনবে।
৪. চুরি হওয়া ফোনের IMEI ব্লক করা যাবে, ফলে ফোন চুরি বা প্রতারণা রোধ করা সহজ হবে।
ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে:
এখন সময় এসেছে, সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, টেলিকম অপারেটর ও শিল্পখাতের সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার। যারা NEIR নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অনলাইনে যারা রিফার্বিশড বা অফিশিয়াল না হলেও ভালো ফোন নামে অবৈধ পণ্য বিক্রি করছে, তাদের পেজ ও ওয়েবসাইটও কঠোর নজরদারিতে আনতে হবে। সেই সাথে সাধারণ জনগণকেও সচেতন হতে হবে—সস্তা দামের লোভে যেন কেউ অবৈধ ফোন না কেনেন। কারণ এতে আপনি যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি দেশের বৈধ শিল্পকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।
আত্মনির্ভরতার পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা:
NEIR কেবল একটি প্রযুক্তি নয়; এটি বাংলাদেশের আত্মনির্ভরতার প্রতীক। দেশে যখন নিজস্ব কারখানায় স্মার্টফোন তৈরি হচ্ছে, তখন বিদেশি চোরাচালানের কোনো যৌক্তিকতা নেই। যে দেশ নিজেই স্মার্টফোন তৈরি করতে পারে, সে দেশকে আর অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না। ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয়ের দিনে NEIR চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বকে জানাবে— 'আমরা কেবল ব্যবহারকারী নই, আমরা উৎপাদকও।' 'আমরা চাই বৈধ ব্যবসা, ন্যায্য প্রতিযোগিতা, এবং নিরাপদ ডিজিটাল বাংলাদেশ।'
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এর সর্বশেষ খবর