কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার যাদুরচর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পিয়ন বাবলু মিয়ার বেতন-ভাতা দীর্ঘ ২৬ মাস ধরে অবৈধভাবে বন্ধ রেখেছেন প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বেতন-ভাতা ছাড় এবং বাবলু মিয়াকে স্ব-পদে বহাল রাখার নির্দেশ দিলেও তা মানছেন না প্রধান শিক্ষক। উল্টো ওই কর্মচারীকে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন ২০১৫ সাল থেকে যাদুরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদে রয়েছেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে বাবলু মিয়া 'পিয়ন' পদে যোগদান করেন এবং এমপিওভুক্ত হয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করতেন। ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সরকারের এক পরিপত্রে 'পিয়ন' পদের নাম পরিবর্তন করে 'অফিস সহায়ক' নামকরণ করা হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এবং শিক্ষা অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জালিয়াতি করে বাবলু মিয়াকে চাকরিচ্যুতির চেষ্টা করেন। এর অংশ হিসেবে ২০২৩ সালে পিয়ন বাবলুর বিরুদ্ধে মাউশিতে একটি অভিযোগ দেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর এই বিষয়ে উভয় পক্ষের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পরে একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর মাউশির শিক্ষা কর্মকর্তা (মাধ্যমিক-১) নাজিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বাবলু মিয়াকে স্ব-পদে বহাল রাখার নির্দেশ এবং স্কুল কর্তৃপক্ষকে বন্ধকৃত সকল বেতন-ভাতাদি প্রদান করে মহাপরিচালককে অবগত করার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু দীর্ঘ ১১ মাস পার হলেও প্রধান শিক্ষকসহ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাউশির এই নির্দেশকে কোনো প্রকার তোয়াক্কা করছেন না। উল্টো চলতি বছরের ১২ এপ্রিল ওই কর্মচারীকে জিম্মি করে ৩০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল ফাঁকা স্ট্যাম্পে জোর করে স্বাক্ষর নেন প্রধান শিক্ষক। এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি ইউএনও এবং জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করলেও প্রায় ৭ মাসেও সেই স্ট্যাম্পের কোনো হদিস নেই।
বাবলু মিয়া পিয়ন (অফিস সহায়ক) পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল 'অফিস সহায়ক' ও 'পরিচ্ছন্নতাকর্মী' পদে নতুন করে লোক দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন প্রধান শিক্ষক। এর প্রতিকার চেয়ে ১৭ এপ্রিল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। অন্যদিকে, দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে কর্মচারী হাজিরা খাতায় 'পিয়ন' পদে স্বাক্ষর করে বেতন-ভাতা উত্তোলন করলেও ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষক মনগড়াভাবে তাঁর পদবি পরিবর্তন করে 'নিরাপত্তাকর্মী' লিখে তাতে স্বাক্ষর করতে বলেন।
পরে এবিষয়ে বাবলু মিয়া ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রৌমারী ইউএনও এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ দেন। এতে দীর্ঘ দিনেও তাঁর কোনো প্রতিকার মেলেনি। অবশেষে চাকরি বাঁচাতে ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই আদালতে মামলা করেন বাবলু মিয়া। মামলায় দু'দফা হেরে গিয়ে হয়রানি করতে বাবলুর বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষক মাউশিতে একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ করেন। সেখানেও ভুক্তভোগী রায় পান।
ভুক্তভোগী বাবলু মিয়া বলেন, "দীর্ঘ ২৬ মাস ধরে শতভাগ অবৈধভাবে বেতন-ভাতা আটকে রেখে প্রধান শিক্ষক আমার পরিবারটা তছনছ করে দিয়েছেন। দৈনিক হাজিরা খাতায় নিয়োগকৃত পিয়ন (অফিস সহায়ক) পদে স্বাক্ষর করতেও দিচ্ছেন না। প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। উল্টো অসুস্থ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন কাটছে।"
মাউশির নির্দেশ উড়িয়ে দিয়ে প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন বলেন, "যিনি নির্দেশ দিয়েছেন তিনি তো আসলে কলেজের স্যার, উনি তেমন আইন-কানুন জানেন না।" স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, "পিয়ন বাবলু স্বেচ্ছায় স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করেছে কিন্তু পরবর্তীতে সে আর এটা মানে না। আদালতের নির্দেশে বাবলু মিয়ার বেতন বন্ধ রয়েছে।" তবে তিনি বেতন বন্ধে নিষেধাজ্ঞা থাকার পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি, রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার হালদার বলেন, "আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাবলু মিয়ার বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে না।" অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে কুড়িগ্রাম জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, "বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর