বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি একসময় দেশটির একটি ধর্মনিরপেক্ষ নায়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন, বর্তমানে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে রাজনৈতিক নির্বাসনে আছেন। গত বছরের ছাত্র–ছাত্রীর বিক্ষোভ দমন ও হত্যার অভিযোগে তাকে অনুপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। যদি ভারত তাকে দেশে ফিরিয়ে দেয়, তবে এই দণ্ড কার্যকর হতে পারে।
এখন তিনি দুই দেশের মধ্যে এক জটিল অচলাবস্থার কেন্দ্রবিন্দু—ঢাকা তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে প্রত্যর্পণের দাবি জানাচ্ছে, আর তিনি দাবি করে যাচ্ছেন, এই অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তিনি এসব অপরাধ করেননি।
রাজনৈতিক জীবন ও প্রাথমিক উত্থান
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক যাত্রা এক নাট্যধর্মী গল্পের মতো – ট্রাজেডি, নির্বাসন ও ক্ষমতার সংমিশ্রণ। ১৯৭৫ সালের আগস্টে এক রক্তক্ষয়ী সামরিক কুপে তার বাবা, মা এবং তিন ভাই নিহত হন। তিনি ও তার বোন তখন পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন, তাই বেঁচে যান। এ কুপের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ওঠেন এবং নিহতদের হত্যাকারীদের সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করেন। এরপর শেখ হাসিনাকে ছয় বছরের নির্বাসনে ভারত যেতে হয়।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে তিনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নেন। একই সঙ্গে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। তখন থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে “ব্যাটলিং বেগমস” যুগ।
প্রথম মেয়াদকাল ও বিচার চেষ্টার সূচনা
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তার প্রথম কাজ ছিল ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচার শুরু করা। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর পর ২০০৮ সালে ফের ক্ষমতায় আসেন। এরপরের ১৫ বছর তিনি দেশকে কঠোরভাবে শাসন করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভারতের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখেন।

আলোচনা ও সমালোচনা
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালে উন্নয়ন আসলেও এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মাধ্যমে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। রাজনৈতিক সহিংসতা, ভোটারদের হুমকি, সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী দলের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার খবরগুলো মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।
২০২৪ সালের ছাত্র–ছাত্রীর বিক্ষোভ ও পতন
গত বছরের সিভিল সার্ভিস চাকরির কোটার দাবিতে ছাত্র–ছাত্রীদের বিক্ষোভ ধীরে ধীরে সমগ্র দেশে একটি গণজাগরণের রূপ নেয়। সরকারী শক্তি ও পুলিশি অভিযান চলাকালীন অন্তত ১,৪০০ জন নিহত হয়। এই রক্তক্ষয়ী অভিযান সরকারের পতন নিশ্চিত করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনাকে পালাতে বাধ্য হওয়া তার দোষ স্বীকারের মতো, কারণ “সে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অনেক হত্যার আদেশ দিয়েছিল।”
নির্বাসন ও ভারতীয় শরণার্থী জীবন
বর্তমানে শেখ হাসিনা ভারতের নয়াদিল্লিতে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছেন। ভারত সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান এবং রাজনৈতিক অপরাধ ব্যাখ্যার কারণে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে কিনা তা অনিশ্চিত। তার পরিবার ভারতকে তার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে। ভারত–বাংলাদেশ সীমান্ত নিরাপত্তা বজায় রাখতে তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যা বর্তমানের পতনের পর নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে।
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড এবং তার দলের নেতাদের বিতরণ বাংলাদেশের আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করবে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও অন্যান্য ছোট দলগুলো নির্বাচন করার সুযোগ পাচ্ছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, দেশ এখনও পুনর্মিলনের পথে নয় এবং রাজনৈতিক বিভাজন গভীর।
ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট
শেখ হাসিনার পতন কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিষাক্ত যুগের সমাপ্তি নির্দেশ করছে, নাকি নতুন অনিশ্চয়তার সূচনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে ফেরার চেষ্টা করতে পারে, তবে সম্ভবত শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছাড়া।
সূত্র-সিএনএন।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর