সুন্দরবনে জলদস্যুরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দু'মাসের বাজার-পানিসহ প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম মজুদ করে যেকোনো মুহূর্তে সাগরে জেলেদের জিম্মি করতে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। সম্প্রতি দস্যুদের কবল থেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা এক জেলে, আজহারুল ইসলাম (ছদ্মনাম), রবিবার এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান।
তিনি জানান, গত ২৬শে জানুয়ারি বঙ্গোপসাগরের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় জেলেদের হাতে ৩ জলদস্যু আটকের ঘটনা মাথায় রেখে এবার সক্ষমতা বাড়িয়েছে দস্যুদল। তাদের বহরে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক অস্ত্র যোগ হয়েছে, যার ঝনঝনানিতে সুন্দরবন কাঁপছে।
বর্তমানে ৪/৫টি দস্যুদল পশ্চিম সুন্দরবন জুড়ে রাজত্ব করছে। এর মধ্যে আলিফ বাহিনী এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। সরকার পতনের পর মজনু বাহিনী ৬/৭ জন সদস্য নিয়ে দ্বিতীয় দস্যুদল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সুন্দরবনের বনজীবীদের উপর নির্যাতন শুরু করে। জেলেদের উপর অবৈধ টাকা আদায়ের চাপ দেওয়া হতো এবং টাকা দিতে না পারলে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। পরিবারের কাছে মোবাইল ফোনে নির্যাতনের আহাজারি শোনানো হতো দ্রুত মুক্তিপণ আদায়ের জন্য। ছয়-সাত মাস এভাবে নির্যাতন চালানোর পর মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু গাজী ৬ মাসের জন্য ৫৮ লক্ষ টাকায় তার প্রভাব বিক্রি করে ভারতে পাড়ি জমায়। এরপর থেকে কুখ্যাত বনদস্যু আলিফ সুন্দরবনে একক আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।
আলিফের ৬/৭ জনের দলটি বর্তমানে ১৮ জনের বিশাল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তার বাহিনীতে আলিফ (ওরফে দয়াল বাবা), বাঘা মজিদ, রবিউল, সঞ্জয় মালো, আব্দুল্লাহ, খোকাবাবু সহ রামপাল ও মোংলার সাবেক ও বর্তমান দস্যুরা যোগ দিয়েছে। অপহৃত জেলে ও আত্মসমর্পণকারী এক জলদস্যুর মাধ্যমে জানা গেছে, বাহিনীতে ২টি ৪ সিলিন্ডার ট্রলার এবং ট্রলারের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য ৪টি ওয়াকিটকি আছে। ১৮ জন জলদস্যুর বিপরীতে ১৯টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের বর্ণনা পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ডাবল ও সিঙ্গেল ব্যারেল মিলে ১৪টি বন্দুক, ১টি চাইনিজ রাইফেল, ১টি টুটুয়ার রাইফেল, ১টি নাইন এমএম, ১টি সিক্স শুটার এবং ১টি এইট শুটারগান রয়েছে। সাগরে হানা দেওয়ার জন্য আরও জনবল বাড়াতে দস্যুনেতা আলিফ সাবেক দস্যুদের সাথে যোগাযোগ করছে। দস্যুদলে যোগদানে ৬ মাসে প্রচুর অর্থসহ আত্মসমর্পণের সুবিধা ও বিভিন্ন প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।
অন্যদিকে, সাগর উপকূলের জেলেদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা দস্যুদলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশাশুনি উপজেলার চাকলার (আব্দুর রহিম) ছদ্মনামধারী একজন জেলে জানান, আলোরকোলের জেলেদের মধ্যে এখন আলিফ আতঙ্ক বিরাজ করছে। তার ভয়ে জেলেরা ঠিকমতো মাছ ধরতে পারছেন না। পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের আবু হাসান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মজনু বাহিনীর হাতে ১৯ জন জেলেকে মুক্ত করতে মাথাপিছু দুই লক্ষ আশি হাজার টাকা করে মোট ৫৩ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। সেই ক্ষতি এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, এর উপর নতুন করে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে।
আলোরকোলের চাকলা বেল্টের সভাপতি আব্দুর রউফ মেম্বার বলেন, এ বছর কোস্টগার্ড বেশ তৎপর। বেয়লা-কয়লার যে সকল স্থান দিয়ে জলদস্যুরা প্রবেশ করে সেখানে কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে। জলদস্যুদের উপর সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রতিনিয়ত টহল চলছে। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনী সাগর পাড়ের জেলেদের নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে সহায়তা করতে এবং দস্যুদের অতর্কিত হামলা রুখে দিতে প্রতিনিয়ত টহল পরিচালনা করছে। তারা বলছে, জেলেদের নির্বিঘ্নে মৎস্য আহরণের সার্বিক ব্যবস্থা করা এবং দস্যুতা নির্মূলে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর