গত বছরের ৫ই আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন ও তার পলায়নের পর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। খুন, ছিনতাই, এবং অন্যান্য নৃশংস অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব অপরাধের প্রায় প্রতিটিতেই অপরাধীরা নিজেদের আড়াল করার জন্য মাস্ককে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, যা বর্তমানে জনমনে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত জনসমাগমস্থলে মাস্কের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবি তুলেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর অপরাধে মাস্কের ব্যবহার বিশেষভাবে সামনে এসেছে।
সর্বশেষ জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সন্দেহের তীর ঘোরছে মাস্ক পরা দুই তরুণের দিকে। হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ফয়সাল করিম মাসুদ বা দাউদ খান নামে এক ব্যক্তির ছবি বহুল আলোচিত হচ্ছে।
হাদি ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের দাবি, গুলিবিদ্ধ হওয়ার কয়েক দিন আগে থেকেই মাস্ক পরা এই দুই তরুণ সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির গণসংযোগে অংশ নিচ্ছিলেন। বারংবার তাদের মাস্ক খুলতে অনুরোধ করা হলেও তারা রাজি হননি। হাদি ঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যেই তাঁর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের দিকেই ইঙ্গিত করে।
মাস্ক ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ করার এমন ঘটনা কেবল একটি নয়। তালিকাটি বেশ দীর্ঘ:

মোহাম্মদপুরের মা-মেয়ে খুন: গত সোমবার সকালে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের বাসায় নৃশংসভাবে মা লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তাঁর মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫) খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন গৃহকর্মী আয়েশা। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আয়েশা বোরকা পরে বাসায় ঢোকেন এবং খুনের পর স্কুল ড্রেস ও মাস্ক পরে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। গৃহকর্মীর স্বামীর ভাষ্য অনুযায়ী, চুরি করার সময় লায়লা আফরোজ বাধা দেওয়ায় আয়েশা তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন এবং পরে তাঁর মেয়েকেও হত্যা করেন। অপরাধী নিজেকে আড়াল করতে সচেতনভাবে মাস্ক ব্যবহার করেছে, যা প্রমাণ করে অপরাধের প্রস্তুতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

পুরান ঢাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী খুন: গত ১০ই নভেম্বর পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে ইমন-মামুন গ্রুপের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাঈদ মামুনকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও মাস্ক পরা ছিল।

রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়ন বিএনপির কর্মী আবুল হাশেম হত্যায় জড়িত আসামিরা জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তারা বোরকা ও মাস্ক পরে অবস্থান নিয়ে রশি দিয়ে পথরোধ করে হাশেমকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেন।
এছাড়াও, গত মে মাসে প্রকাশ্যে একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে, যেখানে অপরাধীরা মাস্ক পরে নিজেদের পরিচয় গোপন রেখেছে। যেমন:
মগবাজার ও পল্লবীর ছিনতাই: গত ১৮ মে মগবাজারে যুবককে কুপিয়ে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ২৪ মে পল্লবীর মেট্রো স্টেশনের নিচে একই কায়দায় ছিনতাই ঘটে।
মিরপুরে দিনে-দুপুরে ডাকাতি: ২৭ মে রাজধানীর মিরপুরে দিনদুপুরে ফাঁকা গুলি ছুড়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর সহকারীর কাছ থেকে ২২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যেখানে দুর্বৃত্তরা মাস্ক পরে ছিল। এই ঘটনার কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই উদ্বেগজনক অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মাস্কের অপব্যবহার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, "মাস্কের ব্যবহার একটি জনস্বাস্থ্যজনিত অভ্যাস হিসেবে শুরু হলেও, বর্তমানে এটি অপরাধীদের জন্য একটি সহজ ও সস্তা গোপন অস্ত্র হয়ে উঠেছে। যখন কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটা ভঙ্গুর, তখন অপরাধ দমনে সাময়িক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। নির্বাচন পর্যন্ত জনসমাগমস্থলে মাস্ক পরায় সাময়িক নিষেধাজ্ঞা বা কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে অপরাধীদের চিহ্নিত করা অনেক সহজ হবে।"
অন্যদিকে, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, "এই অপরাধ প্রবণতা আসলে শাসনের দুর্বলতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফল। মাস্ক নিষিদ্ধ করার চেয়েও জরুরি হলো দ্রুত অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং বিচারের আওতায় আনা। তবে, নির্বাচনকালীন সংবেদনশীল সময়ে টার্গেটেড কিলিংয়ের আশঙ্কা থাকায়, প্রশাসন প্রয়োজন মনে করলে ভিভিআইপি মুভমেন্টের আশেপাশে বা নির্দিষ্ট স্পর্শকাতর এলাকায় মাস্ক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।"
বিভিন্ন অপরাধে মাস্কের অপব্যবহারের ঘটনা সামনে আসার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'মাস্ক নিষিদ্ধ করা হোক' এই দাবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ফেসবুক ব্যবহারকারী আহমেদ কবির লিখেছেন, "দেশে এখন আর কোভিড নেই। কিন্তু অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের নিরাপত্তা দরকার। মাস্ক নয়, চাই পুলিশের গতিশীলতা এবং কঠোর হাতে অপরাধ দমন। নির্বাচন পর্যন্ত মাস্কের ব্যবহার বন্ধ রাখলে অন্তত অপরাধীরা দ্রুত ধরা পড়বে।"
আরেকজন ব্যবহারকারী ফারহানা ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, "দিনের পর দিন মা-বোনেরা খুন হচ্ছেন, মানি এক্সচেঞ্জের টাকা লুট হচ্ছে। আর সব অপরাধী মাস্ক পরে পার পেয়ে যাচ্ছে! এই ঢাল ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি নিষিদ্ধ করা হোক!"
বাংলাদেশে বর্তমানে যে ধরনের নৈরাজ্য ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে, তাতে মাস্কের ব্যবহার অপরাধীদের আরও উৎসাহিত করছে। সাধারণ মানুষ অপরাধীদের সহজে শনাক্ত করতে পারছে না, যা তদন্ত কার্যক্রমকেও বাধাগ্রস্ত করছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য, মাস্ক ব্যবহারের ওপর সাময়িক বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে কিনা, তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্তই হয়তো অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।
সর্বশেষ খবর