নির্বাচন পেছাবে না মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, কেউ নিজের স্বার্থে নির্বাচন পেছাতে চাইলে বাংলাদেশের মানুষ সেটা মেনে নেবে না। তবে একটা গোষ্ঠী যারা নির্বাচন চায় না তাদের সম্পর্কে তো জনগণের এই সন্দেহ আছে। নির্বাচন না হলে দেশের মানুষ দেশের মালিকানা ফিরিয়ে না পেলে নির্বাচিত সংসদ না থাকলে যারা লাভবান হবে মনে করছে তাদের সম্পর্কে জনগণের সন্দেহ তো রয়ে গেছে।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর রেডিসন ব্লু বে ভিউ হোটেলে ‘বাণিজ্য সংলাপ’ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে একথা বলেন তিনি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যবসায়ী ফোরাম আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে আমীর খসরু প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের দেশে ফেরা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় তার শারীরিক উপস্থিতি দলকে এবং দেশের মানুষকে উৎসাহিত করবে। তার কার্যক্রমকে আরও বড় পরিধিতে নিয়ে যেতে পারবেন তিনি। দেশের বড় ক্ষতি হয়েছে তার অনুপস্থিতিতে।’
এর আগে বাণিজ্য সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের ক্ষমতা কোনো রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়, জনগণের ক্ষমতাই রাষ্ট্রের জন্য ভালো। এটার জন্যই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের লক্ষ্য হলো জনগণের ক্ষমতার মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা ব্যালেন্স করা। আমরা জনগণের ক্ষমতায় ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে চাই।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যেকটা বিষয়ে ব্যুরোক্রেসির হাত থেকে তুলে ব্যবসায়ীদের হাতে দিতে চাই। এজন্য ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি- আগামী দিনে যারা এক্সপোর্ট করবে তাদের আমরা ব্যাক-টু-ব্যাক সুবিধা দিবো। আরেকটি হলো অটোমেশন। সব ক্ষেত্রে অটোমেশন করতে হবে। এজন্য একটি সুপারভাইজারি কমিটি করা হবে। এতে একটা কনটেইনার আনতে যত কাজ করতে হয়, যত পারমিশন নিতে হয়, সব অটোমেশনের মাধ্যমে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের এ সম্মেলন করার গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই এক্সারসাইজটা আমরা আসলে গত ছয় মাস ধরে করছি। ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিভাগে করেছি। আজকে চট্টগ্রামে করছি। শুধু ঢাকা বাকি রয়েছে। প্রায় সময় আমরা দেখেছি, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কাজে রাজনীতিবিদদের অর্থাৎ মন্ত্রী-এমপিদের কাছে যায়। আমরা এই সিস্টেমটা ভাঙতে চাই। এই এক্সারসাইজের উদ্দেশ্য হলো- রাজনীতিবিদরা আপনাদের কাছে আসবে।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বের কোথাও সব কনটেইনার পরীক্ষা করা হয় না। দক্ষতা ও আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবস্থার মাধ্যমে কোন কনটেইনার যাচাই হবে, তা নির্ধারণ করা হবে। এতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের সুযোগ কমে আসবে এবং দুর্নীতির পথ বন্ধ হবে।
তিনি জানান, সফটওয়্যারই নির্ধারণ করে দেবে কোন কনটেইনার যাচাই করা হবে। যে ২ শতাংশ কনটেইনার যাচাই করা হবে, সেগুলোরও অডিট করা হবে। এর ফলে মাল খালাসের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। সময় ও খরচ কমিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই সরকারের মূল লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট ধ্বংস হয়ে গেছে উল্লেখ করে সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যত উন্নত দেশ দেখবেন ক্যাপিটাল মার্কেটের সাথে দেশের গ্রোথ, ডেভেলপমেন্ট, ইনভেস্টমেন্ট সরাসরি জড়িত। আমেরিকার মার্কেট ক্যাপিটাল জিডিপির দ্বিগুণ। ভারতের মার্কেট ক্যাপিটাল জিডিপির ৬০-৭০ শতাংশ। বাংলাদেশের মার্কেট ক্যাপিটাল জিডিপির ৪-৫ শতাংশ। আমি সারপ্রাইজড এত ছোট ক্যাপিটাল মার্কেট দিয়ে আমরা যতটুকু করতে পেরেছি। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে। ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপ ছাড়া আমরা যে ধরনের ইকোনমির কথা বলছি, যে জায়গায় যেতে চাইছি সেখানে যেতে পারব না।
আমীর খসরু বলেন, এ জন্য আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটের কাজ শুরু করেছি। আমরা গ্লোবাল ফান্ড ম্যানেজারদের সঙ্গে কথা বলছি। রেগুলেশন, প্রডাক্টগুলো দেখছি। বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট ফ্রন্টিয়ার, অর্থাৎ একদম নিচে। আমরা যদি ইমার্জিং মার্কেটে ঢুকতে পারি, সারা দুনিয়া ফান্ড নিয়ে বসে আছে। বাংলাদেশি অরজিন অনেক ফান্ড ম্যানেজার একেকজন ১৫ বিলিয়ন, ৩০ বিলিয়ন ডলার অলরেডি ম্যানেজ করছে। তারা চীনে বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করছে কল সেন্টারে। ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ছাড়া ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমি আমরা করতে পারব না। ক্যাপিটাল মার্কেট বোঝে এমন লোকজন জয়েন করবে। বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিটিসিএল, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, বিডা এগুলোতে আমাদের স্পেশালাইজড লোকজনকে হাই পে দিয়ে আনতে হবে। আপনি এক লাখ টাকা বেতন দিয়ে বিএসইসি চালানোর লোক পাবেন না। তাকে তার পে দিতে হবে। গভর্নরকে ওইভাবে পে করতে হবে। আমি গর্বের সঙ্গে বলতে চাই, বিএনপি সরকার কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পলিটিক্যাল নিয়োগ দেয়নি। এ জন্য বিএনপির সময় স্টক মার্কেট কলাপস করেনি, স্ক্যান্ডেল হয়নি। ব্যাংকিং সেক্টর আমাদের সময় সাফার করেনি।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কের ধরন বদলানোর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, গত ছয় মাস ধরে দেশজুড়ে বিভাগ ভিত্তিক এই বাণিজ্য সংলাপ চলছে। ইতোমধ্যে প্রায় সব বিভাগে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হলো সর্বশেষ ধাপের অন্যতম আয়োজন। কেবল ঢাকা বিভাগের সংলাপ বাকি রয়েছে।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কাজে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের কাছে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে রাজনীতিবিদদেরই ব্যবসায়ীদের কাছে আসার সংস্কৃতি চালু করাই এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিজিএমইএ-এর প্রথম সহ-সভাপতি সেলিম রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রামে আরো ইপিজেড করা দরকার। যদি করেন আমরা ইন্ডাস্ট্রি করবো। পাশাপাশি এসএমই-কে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া চট্টগ্রামে ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহযোগিতা পেলে আমরা জাতীয় অর্থনীতিতে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবো।’
এশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ সালাম বলেন, ব্যবসা সহজ করে করার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। এখানে উপস্থিত অনেক ব্যবসায়ী কঠোর পরিশ্রম, নানা প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে আছেন। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের নিজেদের সমস্যার কথা বলার সুযোগ প্রয়োজন এবং সেই সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ হলো- আমরা অভিজ্ঞ চালক সৃষ্টি করতে পারিনি। এজন্য আমাদের কাজ করতে হবে। চালকদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে আমরা দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। এতে ব্যবসায়িকভাবেও আমরা লাভবান হবো।’
রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. মামুনুর রশীদ বলেন, পার্বত্য জেলার ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ব্যাংক সাপোর্টের অভাব। বিগত ফ্যাসিস্ট আমল থেকে তিন পার্বত্য জেলার ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। পার্বত্য তিন জেলায় ইপিজেড চালু করা হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং এর মাধ্যমে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট সুলতানা নূরজাহান রোজী বলেন, সব ব্যবসায়ী এক প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হয়ে সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করলে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ইচ্ছেশক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উইমেন চেম্বার নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সহায়তার মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা তৈরি করে যাচ্ছে।
বারভিডার সাবেক মহাসচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরকে কোনোভাবে আঞ্চলিক মনে করবেন না। এটি জাতীয় বিষয়। আমি বিএনপির ৩১ দফা দেখেছি। এখানে বাণিজ্যিক প্রসঙ্গ আছে। তবু আরও কিছু আলোচনা করার আছে। এ বিষয়ে আমীর খসরু ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।’
চেম্বারের সাবেক সভাপতি আলী আহম্মদের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই বাণিজ্য সংলাপে আরও বক্তব্য রাখেন মাদার স্টিল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাস্টার আবুল কাশেম, কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শওকত আলী, সেন্ট্রাল প্লাজা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ তহিনুর আলম টিটু, পিএইচপি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী, বিজিএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি সেলিম রহমান, প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শহিদ উল্লাহ, সি-কম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক, খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মীর আব্দুস সালাম, চট্টগ্রাম জুনিয়র চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জুনায়েদ আহমদ রাহাত, চট্টগ্রাম ফার্নিচার প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মাকসুদুর রহমান, চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মানিকুর রহমান, বান্দরবান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী সদস্য মো. জসিম উদ্দিনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর