ভোরের নীরবতা ভেঙে যখন খবরটি ছড়িয়ে পড়ল, তখন থমকে গেল একটি দেশ। থমকে গেল রাজপথ, থমকে গেল রাজনীতি, থমকে গেল অসংখ্য হৃদস্পন্দন। আপসহীন নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর নেই—এই একটি বাক্যেই যেন ভেঙে পড়ল লাখো মানুষের বুক।
যে নারী রাজনীতির কঠিনতম সময়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যিনি বারবার কারাবরণ করেছেন, অসুস্থ শরীর নিয়েও মাথা নত করেননি—তার বিদায়ে আজ বাংলাদেশ কাঁদছে।
এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে যখন তার নিথর দেহ বেরিয়ে আসে, তখন শব্দহীন কান্নায় ভিজে ওঠে চারপাশ। কেউ উচ্চস্বরে আহাজারি করেননি, কেউ স্লোগান দেননি—শুধু চোখের পানি আর নিঃশব্দ ভালোবাসা। গাড়িবহর এগিয়ে চলেছে, আর রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ হাত তুলে শেষ সালাম জানাচ্ছেন সেই নারীকে, যিনি ছিলেন তাদের প্রতিবাদের কণ্ঠ।
গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’—যে ঘর একসময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর সংগ্রামের সাক্ষী ছিল—আজ সেখানে শুধুই শোক। ফুলে ফুলে ভরে যায় আঙিনা, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে মানুষের দীর্ঘশ্বাসে। অনেকে বলছিলেন,
“তিনি আমাদের নেতা ছিলেন না শুধু, তিনি ছিলেন আমাদের শক্তি।”
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ—এই জায়গা বহু ইতিহাস দেখেছে। কিন্তু আজকের দৃশ্য ছিল ভিন্ন। লাখো মানুষের উপস্থিতি, নীরবতা আর চোখের জলে এক অদ্ভুত আবহ। রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে মানুষ এসেছিল শুধু একটি কারণে—শেষ বিদায় জানাতে।
এক বৃদ্ধ নারী ফিসফিস করে বলছিলেন, “এই মহিলা আমাদের জন্য কত লড়েছেন, আজ আমরা তার জন্য দোয়া করতে পারছি—এইটুকুই।”
বেগম খালেদা জিয়ার জীবন ছিল সহজ নয়। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও তিনি দেখেছেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দীর্ঘ কারাবাস, অসুস্থতা আর নিঃসঙ্গতা। তবুও তিনি আপস করেননি। মাথা নত করেননি। তার এই দৃঢ়তা তাকে শুধু একজন রাজনীতিক নয়—একটি প্রতীকে পরিণত করেছিল।
তিনি ছিলেন এমন এক নারী, যিনি পুরুষশাসিত রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিলেন লড়াই দিয়ে, ধৈর্য দিয়ে, সাহস দিয়ে।
তার মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন শোকবার্তার নদী হয়ে ওঠে। তরুণেরা লিখেছেন—“আমরা তাকে দেখেছি সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে।” প্রবীণেরা লিখেছেন—“এমন নেতৃত্ব আর ক’জন আসে?”
রাজনীতির বাইরে থেকেও মানুষ তাকে স্মরণ করেছে একজন দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে—যিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে ছিলেন।
স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে তাকে দাফন করার মধ্য দিয়ে শেষ হবে একটি অধ্যায়। কিন্তু শেষ হবেনা না তার গল্প। কারণ কিছু মানুষ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকেন—মানুষের স্মৃতিতে, ইতিহাসে, সংগ্রামে।
আজ দেশ কাঁদছে, কিন্তু সেই কান্নার ভেতরেই আছে গর্ব। গর্ব একজন নারীর জন্য, যিনি ভয় পাননি। যিনি হার মানেননি। যিনি হয়ে উঠেছিলেন আপসহীনতার নাম।
সংগ্রামীর বিদায়ে আজ কাঁদছে দেশ—কাঁদছে ভালোবাসায়, কাঁদছে শ্রদ্ধায়, কাঁদছে ইতিহাসের সামনে মাথা নত করে।
সর্বশেষ খবর