জেনে নিন চানাচুরের ইতিহাস

নিউজ ডেস্ক: ধনী-গরীব আর সামাজিক শ্রেণিভেদ এড়িয়ে একটি খাবার সবার অবসরে নিত্যসঙ্গী। একটু কাঁচা পেঁয়াজ-মরিচের কুচি আর কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেলের সাথে মুড়ি-চানাচুরের মাখানো রেসিপি সত্যি বর্ণিল করে তুলতে পারে ঘরে কিংবা বাইরের যেকোনো আড্ডা। ঘরের বৈঠক খানায় আলিশান থালা-বাসন, নিরন্নের শতছিন্ন থালা কিংবা আড্ডাবাজদের সম্বল খবরের কাগজে সমান দ্যুতি ছড়ানো এই খাবারের নাম চানাচুর।
ভারতবর্ষে জন্ম অথচ একদিনও চানাচুর খাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। কিন্তু কেউকি ভেবে দেখেছি কোথা থেকে শুরু হয়েছিলো এই চানাচুরের যাত্রা। কাদের হাত ঘুরে কালের খেয়ায় ভর করে এই চানাচুর মুড়ির সাথে কিংবা চকমকে প্যাকেটে করে হাজির হলো আমাদের হাতে হাতে কিংবা বৈঠক খানার বৈঠক-রাস্তার পাশের আড্ডাবাজিতে?
বর্তমান ভারতীয় সিনেমা শিল্পের প্রাণকেন্দ্র মুম্বাইয়ের বন্দর এলকায় মোগল যুগের মাঝামাঝি কিছু মানুষকে বিশেষ ধরণের মুড়মুড়ে ডালভাজা বিক্রি হতে দেখা যেতো। গুড়ো ডালকে বিশেষভাবে ঝাল মশলা সহকারে ভেজে বিক্রি করা হতো চুড়ানামে। সময়ের আবর্তে এই চুড়া মুম্মাইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করে প্রায় পুরো ভারতজুড়ে। তবে ভারতের নানা স্থানে আলুবিহীন নতুন পদের এই খাবারটি পরিচিতি পায় ভিন্ন ভিন্ন নামে। কোথাও একে ডাকা হতো চিবাড়া নামে, কোথাওবা একে চিব্দু কিংবা ভূষো নামেও পরিচিতি পেতে দেখা গেছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজদের পাশাপাশি আরো অনেক ইউরোপীয় নাগরিকের আগমণ ঘটেছিলো ভারতবর্ষে। তাদের মধ্যেও বেশ মুখরোচক খাদ্য হিসেবে স্থান করে নেয় এই চুড়া। তাদের হাত ধরে এর বিস্তার ঘটে ইউরোপের নানা দেশে। অনেক ইউরোপীয় এলাকায় বেশ জনপ্রিয় এই খাবারকে ডাকা হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে। যেমন, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের অধিবাসীরা প্রথমে মুম্বাই থেকে উৎপত্তিলাভ করা এই খাবারকে ডাকে বোম্বে মিক্স হিসেবে।
মায়ানমারের মানুষের মাঝে ‘সারকালে চিই’ নামে পরিচিত এই ধরণের একটি খাবারের জনপ্রিয়তা মন্দ নয়। শ্রীলঙ্কাতে উত্তেজক গাছ-গাছড়ার সাথে বিভিন্ন ধরণের শুকনো কারি লিফ মিশিয়ে তার সাথে কাসাবা যুক্ত করে বিক্রি করা হয়। এর সাথে সিঙ্গাপুরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘ক্যাকাং পুতিই’ এর বেশ মিল রয়েছে। তবে নেপালের সেই ডালমুঠ কিংবা পশ্চিম বাংলা বা আমাদের বাংলাদেশে যে চানাচুর বিক্রি হতে দেখা যায় তার সাথে তামিল নাড়– ও কেরালার মিক্স্রারের বেশি মিল রয়েছে। সেখানে পাকোড়া, চানা ডাল, বুন্ধি, কারাসেভ, মুরুক্কু আর ওমাপড়ি একসাথে মিশিয়ে ব্রিক্রি হতে দেখা যায় যা খাবার হিসেবে বেশ জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু। সবথেকে অবাক কাণ্ড এই চানাচুর আফ্রিকার দেশ কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা এমনকি খোদ দক্ষিণ আফ্রিকাতে পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে চিবদো বা চিবরা নামে। তবে এখানে ঝালের বদলে মিষ্টি জাতীয় চানাচুরও বিক্রি হতে দেখা যায়। আর দক্ষিণ আফ্রিকার ‘কাপে মালায়’ সম্প্রদায় এই খাবারকে তাদের মাঝে জনপ্রিয় করেছে ‘শ্লাঙ্গেতজিয়েস’ নামে।
বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এ খাবারটির সবথেকে মজার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একে আপনি মুঠো করে খেতে পারবেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর ঝালমশলা যুক্ত হলে সেটা খাওয়ার জন্য চামচ ব্যবহার করা হলেও তার সাথে চানাচুরের মূল ঐতিহ্য খাপ খায়না। আর এভাবেই চানাচুর স্থান করে নিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এমনকি আমেরিকাতে পর্যন্ত। সেখানে যে কয়টি ভারতীয় শুকনা খাবারের আইটেম দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় হচ্ছে এই চানাচুর। পাকিস্তানেও এই খাবারটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে চিবাড়া বা নিমকো নামে যার সাথে লক্ষৌ অঞ্চলে প্রচলিত নামের বিশেষ মিল রয়েছে। এই জাতীয় একটি অনেক বেশি ঝাল আর কুড়মুড়ে ভাজা ডালের ডিশ আমেরিকায় প্রচলিত হয়েছে গুজরাটি মিক্স বা গথিয়া মিক্স হিসেবে।
এখানে চানাচুরের সাথে প্রচুর চীনাবাদাম আর অসহ্য রকম ঝাল দেয়া হয়ে থাকে। একই ধরণের খুব ঝাল একটি খাবার অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে ভুজিয়া মিক্স হিসেবে।
সমসাময়িককালে বেশিরভাগ মানুষের কোলেস্টরোল ভীতি এই আলুবিহীন ভারতীয় খাবার চানাচুরকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। খুব সম্ভবত উড়িয়া শব্দ চানাচুড়ার অপভ্রংশ থেকে বাংলায় চানাচুর শব্দটি এতো জনপ্রিয় হয়ে থাকতে পারে। তবে এই বিষয় নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা না হওয়ার নিশ্চিত করে কিছু না বলাটাই শ্রেয়। আসলে বিভিন্ন রকম ডালভাজার সাথে, অসাধারণ স্বাদের কিছু মশলা, তেল, ঝাল, সবুজ মটরভাজা, চীনাবাদাম, কর্ন আর লবনের মিশ্রণে তৈরি হওয়া সুস্বাদু একটি কুড়মুড়ে খাবারকেই আমরা জানি জানি চানাচুর হিসেবে। মীর জুমলার সময়কালে আগত বাহিনীর সাথে বেশ কয়েকজন বাবুর্চির আগমণ ঘটেছিলো বর্তমান বাংলাদেশে।
একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে সেই সময় থেকেই বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এই খাবারটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার শেকড় খুঁজে নেয়া যেতেই পারে। সময়কাল বিচারে তাই অন্যসব মোগলাই খানার সমসাময়িক হবে এই চানাচুর। এর সময়কাল তাই কমপক্ষে ৪০০ বছর ধরে নেয়াটা বোধকরি ভুল হবে না।
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]

পাঠকের মন্তব্য: