সাপের খামার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন!

প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০১৮, ০৭:৪২ পিএম

প্রতিনিয়ত সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে বাংলাদেশে। নতুন নতুন আবিষ্কার আর ভালো উদ্যোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ দেশ। উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কিছু বিষাক্ত সাপের খামার। মূলত সাপ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বিষ সংগ্রহ, রপ্তানি এবং প্রতিষেধক তৈরির উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছে এসব খামার। কিছু সাহসী ব্যতিক্রমী উদ্যোক্তার প্রচেষ্টায় আজ উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় থমকে আছে সম্ভাবনাময় এই শিল্প। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ঝালকাঠির রাজাপুরে নিবিড় পরিচর্যায় গড়ে উঠেছে এমনি একটি বিষধর সাপের খামার।  

সরকার বেসরকারি উদ্যোগে সাপের বাণিজ্যিক খামার স্থাপনের জন্য ২০টি শর্ত দিয়ে ২০০৮ সালের নভেম্বরে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করলেও কষ্টে উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করে খামার মালিক যুবক সালাউদ্দিন শুরু করতে পারছেন না বিষ উৎপাদনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। প্রতিমাসে কোটি টাকার বিষ উৎপাদনে সক্ষম ওই খামারটি বিষ উৎপাদনের জন্য নিবন্ধনের আবেদন করে এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায়। বিস্ময়কর ওই খামারটি দেখতে কৌতহলী মানুষ প্রতিদিন ভিড় করছেন খামারির বাড়িতে। দেখছেন বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ, শুনছেন সাপ নিয়ে অজানা তথ্য ও সম্ভাবনার কথা। 

রাজাপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের চর রাজাপুর গ্রামের সালাউদ্দিন মৃধা নামের এই তরুণ তার নিজ বাড়িতেই নিবিড় পরিচর্যায় গড়ে তুলেছেন বিষধর এই সাপের খামার। খামারের নাম দিয়েছেন ‘রাজাপুর কোবরা ভেনম’। দেশি কোবরা, শঙ্খীনি জাতের সাপ নিয়েই গড়ে তুলেছেন খামারটি। গত বছর ৫টি সাপ নিয়ে খামারের কার্যক্রম শুরু করলেও এখন প্রচুর সাপ আছে তার খামারে। সাপের বিষ রফতানির উদ্যোগ নেয়ার কথা সরকার ঘোষণা করার পর অনুপ্রাণিত হয়ে সালাউদ্দিন খামারটি গড়ে তোলেন। খামার থেকে প্রতি মাসে কোটি টাকার বিষ উৎপাদন করা সম্ভব বলে তরুণ উদ্যোক্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিষ উৎপাদনের সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারছেন না তিনি। 

সালাউদ্দিন আরো জানান, প্রথমদিকে গ্রামবাসী তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। সাপুড়ে, বেদে বলে ডাকতো। এমন কথাও শুনতে হয়েছে-‘শেষ পর্যন্ত সাপের ব্যবসা করতে হলো’! সেই সাথে ছিল কুসংস্কারের ভয়াল থাবা। কিন্তু এখন দেখেন সবাই তার সাথে। তাই সব সময়ই খামারের নিকটে থাকে উৎসুক জনতার ভিড়। এলাকায় এখন আর কেউ সাপ মারে না। কারও বাড়িতে সাপ ধরা পড়লে তাকে খবর দেয়। তিনি গিয়ে সাপটি উদ্ধার করে খামারে নিয়ে আসেন। গ্রামে কারো বাড়িতে সাপ আছে-এমন সংবাদ পেলেই ছুটে যান তিনি ও তার সঙ্গীরা। পরে সেই বাড়ির বাসিন্দাদের সহযোগিতায় তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন খামারে। মূলত মানুষের হাত থেকে বিপন্ন সাপকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তিনি। ফলে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ‘সর্পপ্রেমী মানুষ’ হিসেবে। 

এদিকে, প্রতিদিন যারাই আসছেন সকলেই খামার দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। নানা দিক জেনে শুনে বাস্তবে দেখে সাপ নিয়ে আতংক, কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণার অনেকটাই কেটে গেছে তাদের। তারাও দাবি জানাচ্ছেন সরকারি সহযোগিতার। খামারে আসে পাশে রোপন করা হয়েছে সাপের খাদ্য সরবরাহের জন্য কলাগাছ। এর মাঝেই বাস করছে সাপের প্রধান খাদ্য ব্যাঙ। পোষা হচ্ছে কোয়েল পাখি। কোয়েলের ডিম সাপের খাবার হিসেবে রাখা হয়। 

এলাকাবাসী বলছে, রাজাপুরে এটি একটি ব্যাতিক্রমধর্মী প্রকল্প। সরকার যদি এই প্রকল্পে পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে দেশের অর্থনীতি এবং ওষুধ শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এই খামার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের পটুয়াখালীর নন্দীপাড়া, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর, রাজবাড়ীর কালুখালী, গাজীপুরের মনিপুর, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, রাজশাহীর ধর্মহাটা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, ঠাকুরগাঁও এবং ঢাকার পাশে ধামরাই গ্রামে রয়েছে সাপের খামার। প্রাণীকূলে সাপ আজ আর শুধু ভয়ানক কোন প্রাণি নয়। এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্প খাতও। দরকার শুধু বিজ্ঞানসম্মত পৃষ্ঠপোষকতা। 

বর্ষাকালে আশ্রয়ের খোঁজে ইঁদুরের গর্ত দিয়ে মানুষের বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ছে বিষধর গোখরা সাপ। বাড়ির লোকজনের চোখে পড়লেই ছড়াচ্ছে ভীষণ আতঙ্ক। আত্মরক্ষার্থে এগুলোকে পিটিয়েও মারা হচ্ছে হরদম। এবছরও ঝালকাঠির বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কিছু এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে। বিষধর গোখরা থেকে যেমন মুক্তি চায় মানুষ, তেমনই ওয়াইল্ড লাইফ বিশেষজ্ঞরা চান, বর্ষা শুরুর আগেই গোখরার আশ্রয় ও বিচরণস্থল সংরক্ষণ করে এগুলোর নির্বিচারে হত্যা বন্ধ করা। 

তারা বলেন, খামার গড়ে এই সাপের বিষ সংগ্রহ করে রফতানির উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ যাতে বিষাক্ত গোখরাও হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মাধ্যম। তবে চাইলেই সাপের খামার করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের আছে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা। 

ওয়াল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গোখরাসহ বৈচিত্র্যময় অনেক প্রজাতির সাপ থাকার পরেও এগুলোর বিষ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা না থাকায় এ বিষয়ে বাণিজ্যিক কোনও উদ্যোগ নিতে পারছেন না আগ্রহীরা। এমনকি সাপের খামার করার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা থাকায় চাইলেই বিনা অনুমোতিতে কারো পক্ষে এমন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। 

অন্যদিকে, ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা থাকায় সীমিত পরিসরে এদেশেও সাপের বিষ দিয়ে কিছু ওষুধ তৈরি হচ্ছে, যদিও এর কাঁচামাল বা বিষ আসছে দেশের বাইরে থেকে। আর অধ্যাপকরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই বিষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের নানা যন্ত্রপাতি রয়েছে। বিষ সংগ্রহের পদ্ধতি জানা থাকার পরও কেবল উদ্যোগের অভাবে কাজটি শুরু হয়নি। কোবরা সাপের বিষ অনেক রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে গবেষণাগারে বিক্রিয়ায় প্রভাবক ও অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কোবরা সাপের বিষ বিশ্বে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত প্রভাবক ও অনুঘটক তৈরিতে ব্যবহার হয়। এ কারণে উন্নত বিশ্বে যেসব দেশ রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে ওইসব দেশে কোবরা সাপের বিষ মূল্যবান। এ ছাড়া কোবরা সাপের বিষ বায়োক্যামিক্যাল (বায়ু জীবাণুযুক্ত অস্ত্র) অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে ওষুধশিল্পে সাপের বিষ ব্যবহার না বাড়লেও উন্নত বিশ্বের গবেষণাগারে পটাশিয়াম সায়ানাইডের টক্সিন তৈরিতে সাপের বিষ ব্যবহার হয়। এ কারণে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ যেসব দেশ রাসায়নিক মৌল বা যৌগ উপাদান তৈরি করে তাদের কাছে কোবরা সাপের বিষ খুবই মূল্যবান। 

পরিবেশগত দিক থেকে চিন্তা করলে বাংলাদেশ সাপ ফার্মিংয়ের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এ দেশের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল বিবেচনা করলে এ দেশও ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকাসহ ইউরোপের মতো স্নেকস ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে যেতে পারে। আমরা বাংলাদেশিরা ইদানীং সাপ ফার্মিংয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এর জন্য দরকার হবে না খুব বেশি ইনভেস্টমেন্ট বা অর্থ। দরকার সরকারের বাস্তব উদ্যোগ ও প্রাইভেট  এনজিও সেক্টরের হাতে এ প্রকল্পটি তুলে দেয়া। 

ইতিমধ্যেই দেশে ঢাকার সাভারের পোড়াবাড়ীতে প্রতিদিন ছোট-বড় নানা জাতের সাপ বেচাকেনার হাট বসতে শুরু করেছে। তবে ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশই বেদে সম্প্রদায়ের। ময়মনসিংহ, শেরপুর ও মধুপুরের পাহাড়ি এলাকার গারো এবং উত্তরাঞ্চলের সাঁওতালরাও বাড়তি রোজগারের জন্য এ হাটে সাপ বিক্রি করতে আসেন। মাঝেমধ্যে বিদেশিরাও আসেন সাপ কিনতে।

বিডি২৪লাইভ/এমকে
 

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: