রোমান সভ্যতার অপরাধজগতের চমকপ্রদ কাহিনী
প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সভ্যতা ছিল রোমান সভ্যতা। জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন কিংবা সমরকৌশলে সেই সভ্যতার আধিপত্য ছিল শত শত বছর। সেইসাথে রাজনীতি-কূটনীতি ও শিল্পকলার জন্যও খ্যাতি অর্জন করেছিল সুপ্রাচীন এই সিভিলাইজেশন। কিন্তু আলোর উল্টো পিঠেই লুকিয়ে থাকে অন্ধকার। রোমান সভ্যতাও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য আর দোর্দন্ড প্রতাপশালী সাম্রাজ্যের অতলে লুকিয়ে ছিল শক্তিশালী অপরাধ জগৎ। চলুন জানা যাক, রোমান সভ্যতার অপরাধ জগতের গল্প।
অপরাধচক্র গড়ে উঠেত ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে:
প্রাচীন রোমের রাজপথের নিচে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ আর গুহাগুলো দখল করে রেখেছিলো রোমের অন্ধকার জগতের ক্রিমিনালরা। এই প্যাঁচানো গোলকধাঁধাগুলো ছিলো পালিয়ে যাওয়া দাস আর অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত অপরাধীদের কেন্দ্রস্থল। অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে, পোকামাকড়ে ভরপুর আর আগের বাসিন্দাদের লাশ আর কঙ্কালে ছড়িয়ে থাকা সুড়ঙ্গগুলো এমন কোনো জায়গা নয়, যেখানে লোকজন থাকতে চাইতো।

পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসরা প্রথম সুযোগেই এখান থেকে সটকে পড়তে চাইতো, তবে এর কারণ শুধুমাত্র এর বিষণ্ণময় পরিবেশ নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৭১ অব্দে স্পার্টাকাস নামের এক গ্ল্যাডিয়েটরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয় রোমানরা। এই গ্ল্যাডিয়েটর পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদেরকে একত্রিত করে রোম দখলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। প্রায় দুইবছর ধরে চলা তৃতীয় সেভিল যুদ্ধে রোমের জন্য বেশ বড় বিপদ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন এই রোমান গ্ল্যাডিয়েটর। তারপর থেকেই পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের তাদের অপরাধের শাস্তি বাড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকগুণ। ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে তাই চোখমুখ বুজেই সুড়ঙ্গের অসহ্য পরিবেশ সহ্য করে নিতে হতো পলাতকদেরকে, আর প্রথম সুযোগেই চলে যেতো রোমের জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ থেকে যতটা দূরে যাওয়া যায়।
গোলকধাঁধা রুপ এই সুড়ঙ্গের একমাত্র স্থায়ী বাসিন্দা ছিলো ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা। রোমানরা সাধারণত অন্য ধর্মের দেবতাদের উপরও বেশ উদারমনা ছিলো, তিনটি ধর্ম ছাড়া- ইহুদী, খ্রিস্টান আর বাক্কানালিয়া। রোমানদের ভাষায় এই তিন ধর্মানুসারীরা রোমান ধর্মের জন্য হুমকি। বাক্কানালিয়া ধর্ম রোমানরা আয়ত্ত করেছিলো গ্রিকদের কাছ থেকে। এই ধর্মের অনুসারীরা প্রধান দেবতা বাক্কাসের পূজা করতো অদ্ভুত পদ্ধতিতে। মাতাল হয়ে খোলামেলা জায়গাতেই একত্র হয়ে তারা যৌনমিলনে অংশগ্রহণ করতো। এবং এই গুজবও শোনা যায়, এই কাজ করতে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করতো না বাক্কানালীয়রা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৬ অব্দে, বাক্কানালীয়দের বিরুদ্ধে বিশেষ আইন তৈরি করা হয়, যার ফলে তাদেরকে আশ্রয় নিতে হয় সুড়ঙ্গের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
রাজপথের অপরাধ:
রোমের রাস্তায় হাঁটার অপর নাম ছিনতাইকারী আর চোরদের সাথে গলায় গলা মিশিয়ে দেওয়া। কোলাহল আর ভিড়ে রোমের রাস্তা পকেটমারদের জন্য ছিল স্বর্গ। আক্রান্ত ব্যক্তি বোঝার আগেই তার বেল্ট থেকে কেটে নেওয়া পার্স চুরি করে ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া খুব কঠিন কোনো কাজ ছিল না। রোমের গরীব বাসিন্দা, যারা রোমান নাগরিক ছিল না, ছিল নিম্নস্তরের ‘প্লেবিয়ান’, তারাই ছিল মূলত রোমের রাস্তার অপরাধী। আধপেটা, ডিনারে সিরকা আর সীমের বিচি খেয়ে কাটানো এই প্লেবিয়ানরা মূলত লোভের জন্য চুরি করত না, করতো নিজেদের পেট চালানোর জন্য। চুরি করা কয়েকটা মুদ্রা তাদের অভাবকে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল।
জোচ্চুরি, জালিয়াতি কিংবা নকল জিনিস বিক্রি ছিলো মধ্যবিত্ত রোমান ব্যবসায়ীদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। নকল মুদ্রা আর গহনায় ছেয়ে গিয়েছিলো প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বাজার। কিছু ব্যবসায়ী তাদের ওয়াইনের মধ্যে সাগরের নোনা পানি ঢেলে দিতো, কেউ কেউ আবার ছিল বর্তমান সময়ের সুদখোরদের মতো, খুবই উচ্চহারে টাকা ধার দেওয়ার পর পরবর্তীতে সবকিছু কেড়ে নিয়ে একেবারে নিঃস্ব বানিয়ে ছাড়তো। তবে ধরা পড়লে তাদের জন্য শাস্তির বিধানও ছিল বেশ ভয়াবহ, তাদের সামাজিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে কয়েক গুণ টাকা জরিমানা থেকে শুরু করে জনসম্মুখে চাবুক মারাও হতো। এই শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য সওদাগর-ব্যবসায়ীরা আবার নিজেদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা সমিতির প্রচলন ঘটিয়েছিল, যাকে বলা হতো ‘কলেজিয়া’। এই কলেজিয়ার ফলে নির্বিঘ্নে যেমন জোচ্চুরি চালানো যেত, তেমনিভাবে শাস্তি থেকেও রক্ষা পেতো তারা।

অভিজাতদের অপরাধ:
অভিজাত রোমান সমাজেও অপরাধের কোনো কমতি ছিলো না। আদতে, অভিজাত সমাজে অপরাধের ধরণটা ছিল কিছুটা ভিন্ন। কুলীন জাতের রোমানদের চুরি কিংবা জালিয়াতি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা জন্মেছেই সম্পদের পাহাড়ঘেরা জগতে, যা মধ্যবিত্তরা আকাঙ্ক্ষা করতো আর গরীবদের স্বপ্ন ছিল। তাদের জীবন ছিল সাধারণদের তুলনায় অনেক ভিন্ন, তাই অপরাধও ভিন্ন হওয়াটা স্বাভাবিক। আর এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান ছিল রাজদ্রোহিতা। সাম্রাজ্যের প্রধানকে সরিয়ে দিয়ে আরেকটু ক্ষমতা পাওয়ার চেষ্টা ছিল রোমান অভিজাত সমাজের মধ্যে প্রবল, বিশেষ করে রোমান রিপাবলিক যখন রোমান সাম্রাজ্যে রুপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে, তখন এ ধরনের অপরাধের মাত্রাও বেশ বেড়ে যায়।

অভিজাত রোমান পরিবারের কর্তৃত্ব থাকতো মূলত পিতার হাতে, তারপর বড় সন্তান, এভাবে একজনের অনুপস্থিতিতে তার পরবর্তী সন্তানের মধ্য দিয়ে পরিবারের কর্তৃত্বের হাতবদল ঘটতো। রোমান অভিজাত সমাজের সবচেয়ে খারাপ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো প্যাট্রিসাইডকে। প্যাট্রিসাইড হচ্ছে কাউকে টাকার বিনিময়ে নিজের বাবা কিংবা পরিবারের প্রধানকে খুন করানো!
এভাবে পরিবারের উত্তরাধিকার কিংবা টাকা-পয়সা খরচ করার ক্ষমতা তার হাতে চলে আসতো। ব্যভিচার করাও অভিজাত সমাজে অপরাধের চোখে দেখা হতো, কারণ এর ফলে পারিবারিক উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হতো। রোমান সমাজে অপরাধ ছিল সর্বত্র। আর অপরাধ কিংবা এর শাস্তি, অভিজাত-মধ্যবিত্ত বা গরীব, তিন শ্রেণীর মধ্যে বিভেদ থাকলেও এর পিছনে ছিল কারণ ছিল-আরো টাকা, আরো কর্তৃত্ব, আরো ক্ষমতা। সূত্র: হিস্টোরিএক্সট্রা ডটকম
বিডি২৪লাইভ/এএআই
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]





পাঠকের মন্তব্য: