একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পোল্ট্রি খামার!

প্রকাশিত: ০৮ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:২০ পিএম

আনোয়ার হোসেন প্রায় ৪-৫ বছর ধরে পোল্ট্রি খামারী হিসেবে কাজ করে আসছেন। শুরুতে লাভের মুখ দেখলেও এ শিল্পটি এখন তার জন্য শুধুই হতাশা। লোকসানে শেষ হয়েছে তার সকল পূঁজি। বাধ্য হয়ে গত বছর একটি এনজিও থেকে দুই লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও লাভের মুখ দেখেননি। বাধ্য হয়ে এ বছর থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা তার পোল্ট্রি ব্যবসাটি। 

কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার রাজাপাড়া গ্রামের ঘটনা এটি। শুধু রাজাপাড়া গ্রাম নয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নানা সঙ্কটের কারণে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পতিত হচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে বাচ্চা, ডিম ও মাংসের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে শুধু হ্যাচারি মালিকরাই নয় হাজার হাজার খুদে পোল্ট্রি খামারিরও সর্বশান্ত হতে বসেছেন। 

একদিকে বাচ্চা, ডিম ও মাংসের দাম কমেছে অস্বাভাবিক ভাবে। অন্যদিকে মুরগির খাবার ও ওষুধের দাম বেড়েই চলেছে। ফলে এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা পড়েছেন চরম বিপাকে। ক্রমাগত এই অবস্থা চলায় ইতোমধ্যে অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বাকিরাও চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে নতুন কোন উদ্যোক্তা পোল্ট্রি খাতে বিনিয়োগ করবেন না। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পোল্ট্রি খামার। পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন অনেক খামারি। 

অর্থলগ্নিকারি প্রতিষ্ঠানের দেনায় দিশেহারা কয়েক হাজার প্রান্তিক খামারি। কর্মসংস্থান হারিয়েছেন অনেক শ্রমিক। গত ছয় মাসেই বন্ধ হয়ে গেছে কুমিল্লার প্রায় কয়েক’শ খামার বর্তমানে কোন রকমে লোকশান দিয়েও টিকে রয়েছে শতাধিক খামার। 

পোল্ট্রি খামার সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, নব্বইয়ের দশকে কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, সদর দক্ষিণ, লাকসাম, মুরাদনগর, বরুড়া, চান্দিনা, দাউদকান্দি, তিতাস, হোমনা, মেঘনা, চৌদ্দগ্রাম, মুরাদনগর, বুড়িচং, ব্রাহ্মপাড়া, চৌদ্দগ্রামসহ প্রত্যান্ত অঞ্চলে ব্যাপক হারে পোল্টি খামার গড়ে উঠে। শুরুতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও পরে ব্যক্তিগত বিনিয়োগে দিন দিন খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মাংস (ব্রয়লার) ও ডিম (লেয়ার) উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে নিবন্ধন এবং নবায়ন ফি ছাড়া খামার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত করা হলেও সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে খামার নিবন্ধন ও নবায়নের ফি ধার্য করায় খামারিদের নিকট নিবন্ধন ও নবায়ন ফি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। 

সূত্র জানায় ৫ বছরের জন্য লেয়ার মুরগির খামারের নিবন্ধন ফি ধার্য করা হয়েছে ৫ হাজার টাকা, নবায়ন ফি ধার্য করা হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির খামারের নিবন্ধন ফি ধার্য করা হয়েছে ২ হাজার ৫’শ টাকা এবং নবায়ন ফি ধার্য করা হয়েছে ২ হাজার টাকা। অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিলের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও ব্রয়লার মুরগীর বিভিন্ন কোম্পানির পোল্ট্রি ফিডের দাম ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা ২ হাজার  টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৫’শ টাকা হয়েছে। বয়লার মুরগীর প্রতিটি বাচ্চা ২০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪০-৬০ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। এছাড়া ফিড ব্যবসায়ীদের কাচাঁমালের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে প্রতিনিয়ত খাদ্যের দাম বৃদ্ধি অযুহাততো রয়েছেই। 

কুমিল্লার লাকসামের পোল্ট্রি খামারি আবুল কাসেম বলেন, দীর্ঘদিন বিদেশ ছিলাম। ৫ বছর আগে দেশে এসে সকল পুজি বিনিয়োগ করে পোল্ট্র্রি খামার করেছিলাম। ভেবেছি এর মাধ্যমে ভাগ্য বদলাগে। কিন্তু এখন এ শিল্প আমার জন্য অভিশাপ। আগামীতে আর এ ব্যবসা করবো না। কারন আর কতো লোকসান গুনবো।

কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের ঢালুয়া এলাকার পোল্ট্রি খামারি মোস্তাফিজ জানান, পোল্ট্রি খামার করে লোকসান দিতে দিতে নিজের সব হারিয়েছি। তাই বাধ্য হয়ে এ বছর খামার ব্যবসা ছেঁড়ে দিয়েছি।

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের লক্ষণপুর এলাকার খামারি আবুল কালাম জানান, দীর্ঘদিন থেকে পোল্ট্রি খামারের ব্যবসা করে আসছি। কিন্তু এখন আর এ ব্যবসা করতে ইচ্ছে হয় না। খামারে মুরগী উৎপাদন করতে যে টাকা ব্যয় হয়, অনেক সময় বিক্রি করে তাঁর অর্ধেকও পাওয়া যায় না।

মুরাদনগরের আমপালের গ্রামের গৃহবধূ শামীমা আক্তার তিনি অনেক কষ্ট করে ৫’শ মুরগীর শেড করেছিলেন। গত ছয়মাস ধরে ডিম উৎপাদন খরচের সাথে ডিমের দাম না বাড়ায় তাঁর লোকশান হচ্ছে। এর উপর গত ১৫ দিন আগে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ১’শ টাকায়। আসলে অনেকটা মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’য়ের মত।

কুমিল্লার সদর দক্ষিণের রাজাপাড়ার আনোয়ার হোসেন ১ হাজার মুরগীর একটি শেড তৈরি করেছেন। মুরগি বড় করে বাজারজাত করার জন্য খরচ ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে তিনি ৩ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ করেছেন। আশা করেছিলেন মুরগি বড় হলে বিক্রি করে ঋণ শোধ দিবেন। কিন্তু বিধিবাম এখন মুরগি বিক্রি করে মুরগীর খাবারও জোগান দেয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন তাঁর লোকশান হচ্ছে ২ হাজার টাকা। অব্যাহত লোকশানে তাঁর চারদিকে এখন শুধুই অন্ধকার। সদর দক্ষিণ উপজেলার ভুলইন দক্ষিণ ইউনিয়নের পরতীর আল রাজী পোল্ট্রির মালিক আবদুল্লাহ আল বাহার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, লোকসানের কারনে বেতন দিতে না পারায় শ্রমিক বিদায় করে দিয়েছি। নিজেই এখন কাজ করি।

একই উপজেলার পোল্ট্রি মালিক সমিতির নেতা ও ভুশ্চি কাঁচিয়াপুকুরিয়ার এফএম পোল্ট্রির মালিক আদম ছফি উল্লাহ মামুন বলেন, সিন্ডিকেট করে কোম্পানিগুলো বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বাড়তি রাখায় আমরা খামারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। তদন্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লালমাই উপজেলার বাগমারার মাহাদী পোল্ট্রির মালিক ও উপজেলার পোল্ট্রি মালিক সমিতির নেতা নজরুল ইসলাম খোকন বলেন, গত কয়েক ব্যাচে লোকসান হয়েছে। তারপরও ৬০ টাকা ধরে ৮ দিন আগে ৫ হাজার ব্রয়লার বাচ্চা খামারে উঠিয়েছি। মুরগীর দাম স্থীর থাকলে এবারও লোকসান হবে।

কুমিল্লা সীমান্তবর্তী এলাকার কনেশতলা রুপালী প্রোটিং প্রোডাক্ট মালিক হাসান আহমেদ বলেন, আমরা পোল্ট্রি শিল্পের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু বাচ্চা ও খাদ্য কোম্পানিগুলো আমাদের মেরে ফেলতে চাইছে।

কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও মহানগর যুবলীগের আহবায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বছর জুড়ে মাত্র ২০-২২ টাকায় এক দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি হয়। অথচ বাংলাদেশে আট মাসই থাকে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা। এ ছাড়া সয়াবিন, ভুট্টা, গমসহ আনুষঙ্গিক পণ্যের দাম কমলে এবং এ খাতে সরকার ট্যাক্স কমালেও বছরজুড়েই ঊর্ধ্বমুখী থাকে খাদ্যের দাম।

কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল বলেন, পোল্ট্রি শিল্পকে এ গিয়ে নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। এ শিল্পের সমস্যাগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টিগোচরে আনা হবে।

কুমিল্লা জেলা পোল্ট্র্রি মালিক এসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী আব্দুল মালেক জানান, পোল্ট্রিতে সিন্ডিকেটের এতই যে প্রভাব তা কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। আমরা নানাভাবে প্রান্তিক খামারিদের বাঁচাতে দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু কোন ফল হয়নি। ক্রমাগত লোকশানে অনেকেই খামার বন্ধ করে পথে বসেছে। দেনাদারদের ভয়ে অনেকে আবার পালিয়ে থাকে। চোখের সামনে সম্ভাবনাময় এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যেতে অনেক খারাপ লাগে।

এ বিষয়ে প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, ব্রয়লার মুরগীর বাচ্চা, ফিডসহ মুরগীর খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে খামারিরা লোকসানে পড়ে। তাদের বিক্রির চেয়ে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হয়ে থাকে। এজন্য অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। 

তিনি জানান, প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে খামারিদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই খামারিরা একাই এ ব্যবসায় লোকসান গুনতে হয়। এসব কারনে অনেক খামারি এ ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।

 বিডি২৪লাইভ/এমকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: