বরইতলায় একসঙ্গে শহীদ হন ৩৬৫ জন নিরীহ গ্রামবাসী

প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:০৬ পিএম

আজ বিভীষিকাময় ১৩ই অক্টোবর, কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যা দিবস। একাত্তরের এই দিনে স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের ৩৬৫ জন মানুষকে কাতারবন্দি করে একসঙ্গে হত্যা করেছিল। এক দিনে একসঙ্গে এতগুলো মানুষকে হত্যার ঘটনা খুবই বিরল। আজো সেদিনের কথা মনে করে এলাকাবাসী ও শহীদদের স্বজনরা শিউরে ওঠেন। সেদিনের হত্যাযজ্ঞ থেকে আহত অবস্থায় বেঁচে যাওয়া লোকজন আজো সেই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

পাকিস্তানী হানাদার সেনা সদস্যরা কিশোরগঞ্জ শহরে প্রথম ’৭১-এর ১৯শে এপ্রিল প্রবেশ করে। শহরের ডাকবাংলো, আখড়াবাজার কাজীবাড়ি, খরমপট্টিসহ কয়েকটি পয়েন্টে গড়ে তোলে ঘাঁটি। শুরু করে দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস সদস্য সংগ্রহ। শহরের আস্তানা থেকেই আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় চলে তাদের দানবীয় অভিযান।

জেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের একটি এলাকা বরইতলা। ময়মনসিংহ-ভৈরব-ঢাকা রেলপথের পাশেই এর অবস্থান।

একাত্তরের ১৩ই অক্টোবর জেলা সদর থেকে বিশেষ ট্রেনযোগে পাকিস্তানী সেনারা স্থানীয় দোসরদর সঙ্গে নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে বরইতলা এলাকায় পৌঁছে। আগে থেকেই স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আল-শামসরা আশপাশের দামপাড়া, চিকনিরচর, কালিকাবাড়ি, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর, ভুবিরচর, কড়িয়াইলসহ কয়েক গ্রামের চার শতাধিক মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জড়ো করে রেখেছিল হানাদারদের স্বাগত জানানোর জন্য।

হানাদাররা বরইতলায় নামলে কিছু হানাদার সৈন্য রাজাকারদের সহায়তায় পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঢুকে লুটপাটে মত্ত হয়। এরপর যখন এরা গ্রামগুলো থেকে ফিরে আসে তখন এক রাজাকার রটিয়ে দেয়, দু’জন হানাদার সেনাকে গ্রামবাসী গুম করে ফেলেছে। একথা শুনেই উন্মত্ত হানাদাররা সমবেত গ্রামবাসীর ওপর দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার, বেয়নেটের খোঁচা, রাইফেলের বাট, শাবল আর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কয়েক মুহূর্তে ৩৬৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এসময় অনেকে দৌড়ে পার্শ্ববর্তী মসজিদে গিয়ে নামাজের ভান করে রক্ষা পান। কেউ মরে গেছেন ভান করে রক্তাক্ত লাশের স্তুপে পড়ে থেকে রক্ষা পান। আবার কেউ কেউ আহত অবস্থায় মৃতের ভান করে রক্ষা পান। আহতদের কেউ কেউ এখনো সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন।

সেদিন কপালে বেয়নেটবিদ্ধ হয়েছিলেন চিকনিরচর গ্রামের কালু মিয়া। তিনি জানান, তার গ্রামটি হানাদাররা ঘেরাও করলে তিনি পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। এরপর তাকে বরইতলায় নিয়ে এলে এখানে সারি সারি গ্রামবাসীকে গুলি করে আর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করতে দেখেছেন। এক পর্যায়ে তাকেও কপালে বেয়নেট দিয়ে আর মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করলে জ্ঞান হারিয়ে লাশের স্তুপের ওপর পড়ে থাকেন। হানাদাররা তাকে মৃত ভেবে এভাবেই ফেলে রেখে যায়। পরদিন সকালে পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক মহিলা তাকে উদ্ধার করেন। বহুদিন চিকিৎসা করিয়ে সেরে ওঠেন।

বরইতলা গ্রামের মাছুম আলী জানান, সেদিন হানাদাররা অনেকের সঙ্গে তাকেও ধরে এনেছিল। বরইতলায় রেললাইনের পাশে দাঁড় করিয়ে তাদের কয়েকজনকে বলা হয় যেন তারা রাজাকারদের সহায়তা করেন, খাবার সরবরাহ করেন এবং পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেন। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান পেলে যেন হানাদারদের জানান। এরপর তাদের কয়েকজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু অন্যদের আর মুক্তি মিলল না, কয়েক মুহূর্তে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে চিরতরে তাদের প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হলো।

সেদিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে এলাকার যেসকল রাজাকার সহায়তা করেছিল, তাদের কেউ কেউ আজও বেঁচে আছে। এলাকাবাসী এবং শহীদদের স্বজনরা সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শহীদদের স্মরণে বরইতলা এলাকাটির নামকরণ করা হয় ‘শহীদ নগর’। যদিও প্রচারণার অভাবে এ নামটি এখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। এখানে তৈরি করা হয়েছে শোকের প্রতীক গাঢ় কালো সুউচ্চ স্মৃতিসৌধ। স্থাপন করা হয়েছে শহীদদের নামাঙ্কিত ফলক।

২০০০ সনে জেলা পরিষদের উদ্যোগে ৬৬৭ বর্গফুট এলাকা জুড়ে ২৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধটির নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিসৌধটির ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন তৎকালীন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (বর্তমান জনপ্রশাসনমন্ত্রী) এবং নকশা প্রণয়ন করেন সজল বসাক। স্মৃতিসৌধের ফলকে খোদাই করা শহীদদের নাম মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই রক্তাক্ত ভয়াল দিনে।

বিডি২৪লাইভ/এমকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: