এমপিদের লাগাম টানছে না ইসি

প্রকাশিত: ২০ অক্টোবর ২০১৮, ১০:৩৩ পিএম

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপিদের প্রচারের বিষয়ে বিদ্যমান বিধি-বিধানের ওপর থাকতে চায় নির্বাচন কমিশন। এ কারণে এমপিদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণ বিধিমালায় সংশোধনের প্রস্তাব করেনি আইন সংস্কার কমিটি। শুধুমাত্র চারটি বিষয়ে এ বিধিমালায় সংশোধনী আনা হচ্ছে। রোববার নির্বাচন কমিশনের ৩৭তম সভায় খসড়া আচরণবিধির অনুমোদন দেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যমান আচরণবিধিতে এমপিদের কিছু সুযোগ সুবিধা কমিয়ে আনার কথা বলা আছে। কিন্তু সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা এমপিদের আচরণবিধি খর্ব করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

গত ৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে সিইসি এমপিদের জন্য আচরণবিধি সংশোধনের কথা বলেছিলেন। নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকলে আচরণবিধি সংশোধন করে এমপিদের ক্ষমতা খর্ব করা হবে কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কে নূরুল হুদা বলেন, এটা অবশ্যই চিন্তা করা দরকার। তাদের রেখে নির্বাচন করতে হলে আচরণবিধিতে কিছু পরিবর্তন আনা দরকার।

তবে ইসির আইন সংস্কার কমিটির দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, এমপিদের জন্য আচরণবিধি সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে এমপিদের অবস্থান কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আচরণবিধিমালায় সাধারণ ও অল্প কিছু সংশোধন হচ্ছে।

আচরণবিধিমালায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সংজ্ঞায় এমপি, মন্ত্রী স্পিকার সবার কথাই বলা আছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে কোনো প্রকার প্রচারণা করতে পারবে না। আমাদের এই জায়গায় কোনো কাজ করা প্রয়োজন আছে বলে আইন সংস্কার কমিটি মনে করছে না। ইসি কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান আচরণ বিধিমালার ৩, ৪, ৫ ও ১৪ ধারায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার না করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। তবে এসব বিধানই যথেষ্ট নয়। বর্তমানে এমপিরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে যেসব প্রটোকল ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, তা সংবিধান বা নির্বাচনী আইনে উল্লেখ নেই। তাই তফসিলের পর এমপিদের ক্ষমতা খর্বের জন্য নতুন কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

বিদ্যমান নির্বাচনী আচরণবিধিতে উল্লেখ আছে, তফসিলের পর কোনো সাংসদ সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না। এ ছাড়া এলাকায় উন্নয়নমূলক কোনো প্রকল্পও নিতে পারবেন না। এ ছাড়া নানা বিধি-নিষেধ রয়েছে। তবে অতীতের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও ইসি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। এমনকি রাজনৈতিক নেতা ও এমপিদের প্রভাবের কারণে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়না। এ অবস্থায় ভোটের সময় করতে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনার প্রস্তাব করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কিন্তু গত কমিশন সভায় ওই প্রস্তাব এজেন্ডাভুক্ত করা হয়নি। বাক স্বাধীনতা হরণের অভিযোগে মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সভা বর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্র গমনের কারণে আজকের সভায় মাহবুব তালকুদার উপস্থিত থাকছেন না বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।

ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার কমিশনের ৩৭তম সভা ডাকা হয়েছে। এ সভায় তিনটি এজেন্ডা রাখা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮’ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী (প্রার্থিতার পক্ষে সমর্থন যাচাই) বিধিমালা সংশোধন এবং বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য নীতিমালা। সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালায় মোট চারটি সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যমান বিধিমালার ৬(১)(খ) ও ১৪(৪) ধারায় সংশোধনী এবং ৭(৫ক) ও ৯ক ধারা সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। ৭(৫ক) ও ৯ক উপধারা দুটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আচরণ বিধিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকালে ওই সভার কার্যপত্র সিইসি ও অন্য কমিশনারদের দেয়া হয়। ইসি সূত্র জানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ থেকে এমপি, এমপি প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের না রাখার বিষয়ে আচরণবিধির ১৪(৪) ধারায় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কমিটির কোনো সদস্য/নেতা/কর্মী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে পূর্বে সভাপতি বা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বা মনোনীত হইয়া থাকিলে বা তদকর্তৃক কোনো মনোনয়ন প্রদত্ত হইয়া থাকিলে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে তিনি বা তদকর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে থাকিতে পারবেন না।’

এ সংশোধনীর যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সভাপতি বা সদস্য হিসেবে বহাল থাকলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা আছে। সেটা রোধে এ সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০০৯ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালা অনুযায়ী, একজন এমপি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের চারটি পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি হতে পারেন। এ ছাড়া এলাকার অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপির মনোনয়নে (তার) পছন্দের ব্যক্তিরা সভাপতি হয়ে থাকেন। আর অভিভাবক প্রতিনিধি, শিক্ষানুরাগী/বিদ্যানুরাগী, শিক্ষক প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মূলত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাই সদস্য পদে আসীন হয়ে থাকেন।

আচরণ বিধির অন্য তিন প্রস্তাব হচ্ছে- নির্বাচনী সভার বিষয়ে পুলিশের অনুমতি সংক্রান্ত, প্রচারে ডিজিটাল ডিসপ্লে ব্যবহার না করা ও প্রতীক হিসেবে জীবন্ত প্রাণীর ব্যবহার বন্ধ করা। জানা গেছে, বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সভা করতে হলে পুলিশের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে পুলিশের অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ওই বাধ্যবাধকতায় কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।

আচরণ বিধিমালার ৬(১)(খ) ধারা প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, সভা করার আগে দিন, সময় ও স্থান সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে দুটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৬(১)(খ)(অ) এ বলা হয়েছে পুলিশ আবেদনপ্রাপ্তির সময়ের ক্রমানুসারে অনুমতি প্রদান করতে হবে। (আ) লিখিত আবেদনপ্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হবে, তবে উক্ত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেয়া না হলে ওই সময়ের পর আবেদনে উল্লেখিত অনুমতি প্রদান করা হয়েছে মর্মে গণ্য হবে।

অন্য সংশোধনীর মধ্যে বিধি ৭ এর উপবিধি ৫ এর পর (৫ক) নতুন বিধি সংযোজন করে বলা হয়েছে- নির্বাচনী প্রচারে কোনো প্রকার ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ড ব্যবহার করা যাবে না। বিধি ৯ এর পর উপবিধি ৯৫ যুক্তের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতীক হিসেবে জীবন্ত প্রাণী ব্যবহার করা যাবে না। ইসির কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আচরণ বিধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ দুটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদের ভোটগ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৭টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে রোডম্যাপ তৈরি করেছিল ইসি। এর মধ্যে প্রথম বিষয়টি ছিল আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে রোডম্যাপে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৮ মাস বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আইন সংস্কার কমিটি কাজ শেষ হয়নি।

বিডি২৪লাইভ/এজ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: