পাঁচ বছরে বিএনপি কোথায়?

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:১৩ পিএম

১০ বছর ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালে নির্বাচনে না যাওয়ায় সংসদেরও বাইরে ছিল বিএনপি। কোনো আন্দোলন জমাতে পারেনি তারা। পাঁচ বছরের হিসেব-নিকেষে আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে বিএনপি?

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং সমমনা দলগুলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন বর্জনই করেনি, নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছিল। তাদের তখন দাবি ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করা তো দূরের কথা, কোনো কার্যকর আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি। বরং নির্বাচনের আগে ও পরে যে রাজনৈতিক সহিংসতা ও আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে, তার দায় পড়েছে দলটির ওপর। তারপর এই দায় থেকে মুক্তি পেতে পার করতে হয়েছে পাঁচ বছর। ওই সন্ত্রাসের ঘটনায় দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই, আন্তর্জাতিকভাবেও বিএনপি সমালোচনার মুখে পড়েছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি ছিল সংসদে বিরোধী দল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল। আসন কম হোক, তবুও বিএনপি সংসদে ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় একতরফা নির্বাচনের সুযোগ নেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপি সংসদেরও বাইরে চলে যায়। আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে। ফলে প্রায় একযুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি।

এমনকি তারা সংসদেও নেই, যা বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। দলের অনেক নেতা-কর্মী নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। তবে গত পাঁচ বছরে বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। আর তাতে তাদের অনেক প্রার্থী জয়ও পেয়েছেন। যদিও আইনি প্যাঁচে ফেলে তাঁদের অনেকের দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।

বিএনপি অবশ্য এই হতাশা আর নিস্ক্রিয়তার জন্য সরকারের দমন-পীড়নকে দায়ী করছে। তারা বলছে, শত শত মামলা, হামলা আর হয়রানি বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভয়ার্ত করে তুলেছে। দীর্ঘদিন তাদের জনসভা তো দূরের কথা, কেথাও দাড়াতেই দেয়া হয়নি। দলটির দাবি, এজন্য পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেছে সরকার।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনিও একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। এই দণ্ডপ্রাপ্তদের দলের নেতৃত্বে রাখার জন্য চলতি বছরে বিএনপি তার গঠনতন্ত্র সংশোধন করে। কিন্তু সম্প্রতি হাইকোর্ট সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে। তবে বিএনপি'র আপিলের সুযোগ আছে।

চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন। ওইদিনই জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাঁর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। তবে সম্প্রতি দুদক-এর আপিলে সেই সাজার মেয়াদ বেড়ে ১০ বছর হয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামের আরেক মামলায় তাঁর সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। তারেক রহমান একুশে আগস্টের গ্রেনেড মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। তিনি অর্থ পাচারের মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সন্ত্রাসের জের বিএনপিকে গত ৫ বছর ধরেই টানতে হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েকশ' মামলা হয়েছে। আর সম্প্রতি ‘গায়েবি’ মামলা বলে যেসব মামলা হয়েছে, তাতেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি অংশ আসামি।

সর্বশেষ গত বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কমীদের যে সংঘর্ষ হয়েছে, তার দায়ও চাপছে বিএনপির ওপর। যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, ‘সরকার পরিকল্পিতভাবে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে।’

পাঁচ বছরে বিএনপি তার সংগঠনকেও গোছাতে পারেনি। স্থানীয় পর্যায়ে নতুন কমিটি হচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে। কাউন্সিল হচ্ছে না। একবার হয়েছে খালেদা জিয়া মুক্ত থাকার সময়। তবে তা-ও ছিল নিয়ম রক্ষার কাউন্সিল। নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতার কাউন্সিল। ফলে শীর্ষ নেতৃত্বে যে সংকট, সেই সংকট এখন তৃণমূলেও।

বিএনপিতে একটি কথা আছে যে, দলটি পরিচালিত হয় লন্ডন থেকে। তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই বিএনপি নেতাদের। আর এটাও শোনা যায় যে, ৫ ফেব্রয়ারির নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল তারই কথায়। নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত ছিল। কারণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দল সুসংগঠিত হয়।

বিএনপি এখন সেই বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। শুরুতে তারা খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তবে সেই অবস্থান থেকে এখন সরে এসেছে। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তাদের আছে। তবে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাচ্ছে আন্দোলনের অংশ হিসেবে। প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে ডয়চে ভেলে।

ওই প্রতিবেদনে আরও তুলে ধরা হয়- এখন আর বিএনপি একা নয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. কামাল হোসেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এখানে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ, বিএনপিতে এখন তৃতীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা কঠিন ছিল। ঐক্যফ্রন্ট সেই সংকট কাটাতে সহায়তা করেছে।

ঐক্যফ্রন্টের নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এমন একটা সময় ছিল, যখন বিএনপির সবাই তারেক রহমানের দিকে তাকিয়ে থাকত। হুক্কা হুয়া করত। আমি সরকারকে ধন্যবাদ দিই যে, তারা খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে সহায়তা করেছে। তারা বুঝতে পেরছে, এক ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে দল চলে না।’

তিনি বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বিএনপির মধ্যে এই পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আমি তাদের কাছ থেকে জানি। আর এখন ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকেও দেখি। তারা সম্মিলিতভাবে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো এক ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে না। দলের মধ্যে তারা গণতন্ত্র চর্চা শুরু করেছে। খালেদা জিয়াও তাদের গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন। ফলে নেতৃত্বের যে একটি সংকট তৈরি হয়েছিল, তা কেটে যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, বিএনপির গত ৫ বছরে যদি কোনো অর্জন থাকে, সেটা এই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এটা বিএনপিকে সাহস জুগিয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখন বাইরে বের হতে সাহস পাচ্ছে। তারা মনে করছে, তারা এগিয়ে যেতে পারবে।’

বিশ্লেষকদের মতে, ড. কামাল হোসেনকে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে আনা বিএনপির একটা বড় সাফল্য। এটা ভোটের হিসেব নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি ধারা সৃষ্টির বিষয়। এখন দেখা যাক, এই ধারা ধরে রেখে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি কোথায় যেতে পারে।

বাংলাদেশে ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। এই বিচারের প্রশ্নে বিএনপি কখনো স্বচ্ছ অবস্থান নিতে পারেনি। গত পাঁচ বছরেও তার অবস্থান পরিষ্কার ছিল না। এটা হয়ত জামায়াত ও নিজ দলের যুদ্ধাপরাধীদের কারণে হয়েছে। আর জামায়াতকে পরিত্যাগের প্রশ্নেও বিএনপি আগের অবস্থানে আছে। ২০১৪ সালের সহিংসতা, সাঈদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের রায়ের পর সহিংসতায় জামায়াত ত্যাগের চাপ বিএনপির ওপর প্রবল হয়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বিএনপি জামায়াতের ব্যাপারে কী অবস্থান নেয়, তা পর্যবেক্ষণ করছে। এরই মধ্যে বিএনপির মিত্র জামায়াতের দলীয় নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তারা প্রতীকও হারিয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময়ও জামায়াত ইস্যু সামনে আসে। বিএনপি জামায়াতকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিলেও তাদের ২০ দলীয় ঐক্যজোটে জামায়াত আছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভোট এবং আদর্শিক কারণে বিএনপির পক্ষে জামায়াত-বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব নয়। ফলে জামায়াত বিতর্ক বিএনপির পিছু ছাড়বে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার মনে করেন, ‘গত পাঁচ বছরে দল হিসেবে বিএনপি যে ভেঙে যায়নি বা ভাঙা যায়নি – এটাই বিএনপির বড় সাফল্য। নানা সংকট ও ভুল সিদ্ধান্তের পরও বিএনপি ভেঙে কোনো কোনো উপদল বা আলাদা দল হয়নি। এটার পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে। বাংলাদেশে ভোটের ভাগ দু'টি।’

তিনি বলেন, ‘২০১৪-১৫ সালে বিএনপি ভুল সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তার দায় কিন্তু তারা স্বীকার করেনি। ফলে বলা যাবে না যে, বিএনপি ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। তবে এবার নির্বাচনমুখী হয়েছে তার স্বার্থেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াতকে ত্যাগ করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। এটা শুধু ভোটের কারণে নয়, আদর্শিক কারণেও।’

বিএনপি এবার নির্বাচনে না গেলে নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। আইন অনুযায়ী পরপর দু’বার কোনো নিবন্ধিত দল নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। বিএনপি সেটা জানে। আর নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা-কর্মীরা উজ্জ্বীবিত হয়। ১০ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা এই দলটি এবার নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর সেই ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়া-না-যাওয়ার বিষয় নেই। বিষয়টি দল হিসেবে বিএনপির এগিয়ে যাওয়া ও টিকে থাকার।

বিডি২৪লাইভ/এইচকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: