সংসদ নির্বাচনের আচরণ বিধিতেই গলদ

প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০১৮, ০৯:০২ এএম

আহমেদ দীপু: দলীয় সরকারের অধীনে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন আচরণবিধিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুস্পষ্টকরণের অভাব রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর দলীয় সরকারের ‘রুটিন কাজ’ সংজ্ঞায়িত করা নেই। বর্তমান এমপিদের মধ্যে যারা মনোনয়ন পাবেন না তাদের কাজের ক্ষেত্রে আচরণবিধির কোন ধারা প্রযোজ্য হবে সে বিষয়ে কিছু বলা নেই।

প্রটোকলের পরিবর্তে নিরাপত্তার জন্য মন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশ থাকলে আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। নির্ধারিত সময়ের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটের প্রচার বৈধ না অবৈধ এ সংক্রান্ত কিছুই নেই।

নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিষয়টিও স্পষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে অনেক বিষয় সুনির্দিষ্ট না থাকায় আচরণবিধিটি অস্পষ্ট এবং দুর্বল। এ কারণে ভোটে প্রভাব বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ আছে।

অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ইসির বৈঠকে আচরণবিধি সংশোধন হয়। এর আগে সংশোধন উপলক্ষে ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রস্তাব পাঠান। তারা আরপিও এবং আচরণবিধি উভয় ক্ষেত্রেই সংশোধনের প্রস্তাব দেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কোনো প্রস্তাবই আমলে নেয়নি ইসি। অথচ তাদের প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলে বিধিগুলো আরও সুনির্দিষ্ট হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো: রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা সংবিধান ও আইনের বাইরে যেতে পারি না। সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে, মন্ত্রী-এমপিরা পদে থেকেই নির্বাচন করবেন।

পদে থাকার কিছু সুবিধা তারা পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সংবিধান ও আইনগতভাবে আমাদের কিছু করার নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি, তাদের সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধামুক্ত রাখার। তিনি বলেন, আমরা ভোটার, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল- সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

ভোটাররা যেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বিঘ্নে বাসায় ফিরতে পারেন, প্রার্থীরা যেন সাধ্যমতো ও আইনানুগ প্রচার চালাতে পারেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেন সমান সুযোগ পায় আমরা সেই চেষ্টা করছি।

অস্পষ্ট ও দুর্বল আচরণবিধি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, আইন যথেষ্ট আছে। প্রশাসনের রদবদল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তবর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে।

নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের কার্যক্রমের পার্থক্য আছে। উপদেষ্টারা ছিলেন মনোনীত, মেয়াদ ৩ মাস। তাদের দায়িত্ব ছিল রুটিন কাজ করা।

কিন্তু বর্তমান মন্ত্রীরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। তারা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছেন। নির্বাচিত সরকারই বিদ্যমান। কাজেই এ ধরনের সরকারকে যদি নির্বাচনকালীন সময়ে রুটিন কাজের মধ্যে রাখতে হয় তবে তার জন্য সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে।

রুটিন কাজকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। কিন্তু এটা করা হয়নি। ইসিকে মনে রাখতে হবে, এবার দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে। এ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে তাদের বিভিন্ন দিকে খেয়াল রাখতে হবে। গতানুগতিক কাজ করলে হবে না।

তারা বলেন, জনগণ তথা ভোটারের আস্থাই নির্বাচন কমিশনের মূল ভিত্তি। ইসিকে মনে রাখতে হবে, জনগণের বিশ্বাস ধরে রাখতে হলে তাদের কাজগুলো সুস্পষ্ট বিধি-বিধানের ভিত্তিতে হতে হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) কাজ দৃশ্যমান করতে হবে।

কিন্তু তফসিল ঘোষণার পরও জনগণের কাছে ইসির অনেক কাজ দৃশ্যমান নয় বলে তারা মনে করেন। সরকারি দল ও মাঠের বিরোধী দল এবং তাদের নেতৃত্বাধীন জোট থেকে ইসিতে নানা বিষয়ে অভিযোগ দেয়া হচ্ছে।

কিন্তু সেগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে তেমন অগ্রগতি নেই। সমাধান দেয়া হলেও তা দৃশ্যমান নয়। পোস্টার, বিলবোর্ড অপসারণের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১৮ নভেম্বর। কিন্তু অনেক স্থানে এখনও তা বিদ্যমান।

তফসিল ঘোষণার পরও অধিকাংশ থানায় বহাল আগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। তারাই কাজ করছেন। নতুন কোথাও তাদের পদায়ন হয়নি। মন্ত্রী-এমপিরা ডিও দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ওসিকে নিজ এলাকায় পদায়ন করে থাকেন।

এ রীতি প্রচলিত। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য হলেও মন্ত্রী-এমপিদের পছন্দের ইউএনও এবং ওসিদের বদলি করা উচিত ছিল। সেক্ষেত্রে ইসির পদক্ষেপ দৃশ্যমান হতো।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই। কারণ সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।

ইসি যতই আচরণবিধির কথা বলুক- একজন সংসদ সদস্য এমনিতেই নানা ধরনের সুযোগ পান। যা অন্য প্রার্থীরা পান না। তিনি বলেন, রাস্তায় সংসদ সদস্যদের উন্নয়নের ব্যানার-পোস্টার দেখা যাচ্ছে।

নির্ধারিত সময়ের পরও সব অপসারণ সম্ভব হয়নি। সব সরানোর চেষ্টা হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আইনে তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া আছে। কাগজে-কলমে অনেক কিছু আছে। কিন্তু তারা সেগুলো কাজে লাগান না।

সাবেক এ উপদেষ্টা বলেন, যতটা সময় আছে তার মধ্যে আইন-বিধিবিধান কাজে লাগিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির সুযোগ কম। হাতে সময়ও খুব বেশি নেই। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা মানে প্রার্থী হিসেবে মন্ত্রী-এমপি যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন ভোটে অংশ নেয়া সবার জন্য একই ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

এটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। বিভিন্ন বিধিবিধানের মাধ্যমে তারা এটা করে থাকেন। সরকার যথাসম্ভব সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু এবার সে উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। তারা বলেন, অবশ্য এবার সমান সুযোগ দেয়া প্রায় অসম্ভব।

কারণ, সাংবিধানিকভাবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে। এ সরকারের মন্ত্রী আইনমতে বেতন-ভাতাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। বিধি দিয়ে সেটা রদ করা প্রায় অসম্ভব।

সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ৫ উপানুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার দেয়া হয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত অধিকার কোনো বিধি দিয়ে রদ করা যায় না। আচরণবিধিতে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্টদের সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বোঝানো হয়েছে।

নির্বাচনে প্রচার বিষয়ে আচরণবিধিতে এদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- 

১. ‘সরকারের সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড যোগ করিতে পারিবেন না।’ 

২. ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্র ব্যবহার বা অন্যবিধ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করিতে পারিবেন না এবং এতদুদ্দেশ্যে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’

এগুলোসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিধিতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। বর্তমানে কোনো মন্ত্রী এলাকায় গেলে পুলিশ প্রটোকল পান। কিন্তু তারা ভোটের সময় পুলিশ প্রটোকল নেন না।

তবে তাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ থাকে। এক্ষেত্রে শব্দগত কিছু পার্থক্য ছাড়া তেমন কিছু নেই। কারণ প্রটোকলও পুলিশ দেয়- নিরাপত্তাও পুলিশই দেয়। অথচ অন্য প্রার্থীরা পুলিশি নিরাপত্তা পাচ্ছেন না।

যদিও ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, কেউ চাইলে পাবেন। বাস্তবে এটা কঠিন। বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা একাদশতম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- তারা সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

একই ভাবে তাদের জন্য আচরণ বিধিতে উল্লিখিত বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হবে। কিন্তু যেসব এমপি এবার মনোনয়নবঞ্চিত হবেন তাদের ক্ষেত্রে বিধির কোন ধারা বা আদৌ কোনো ধারা প্রযোজ্য হবে কিনা তা উল্লেখ নেই।

বিশ্লেষকদের মতে ওইসব সংসদ সদস্যের জন্য কেন আচরণ বিধি প্রযোজ্য হবে। তারা কেন সংসদের মেয়াদ থাকা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট প্রকল্প উদ্বোধন বা এ সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে জড়াতে পারবেন না।

এ ধরনের বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। এসব প্রসঙ্গে নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ইসির নির্বাচন আচরণবিধিতে অনেক গ্যাপ আছে।

এ গ্যাপ পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। তিনি বলেন, এক কথায় বললে হবে না যে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা কিভাবে প্রচার চালাবেন তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে।

মন্ত্রী কোথাও গেলে সেখানে লোকজন সমবেত হবে, মিছিল হবে। এটা বললেই বন্ধ হবে না। যেসব সংসদ সদস্য এবার মনোনয়ন পাবেন না তাদের জন্য আচরণবিধির কোন ধারা প্রযোজ্য হবে এটা স্পষ্ট করতে হবে।

তিনি বলেন, এক কথায় বলা হল মন্ত্রীরা প্রটোকল পাবেন না- নিরাপত্তা পাবেন। কিভাবে পাবেন, অন্য প্রার্থীরাও পাবেন কিনা তা জানাতে হবে। তিনি বলেন, দেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান আচরণবিধিমালা যথেষ্ট নয়।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমপিদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে। যেমন- আইনি কাঠামোতে একজন এমপি উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা। তাকে কোন আইন বলে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম থেকে বিরত রাখবেন?

এজন্য সুনির্দিষ্ট বিধান থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে দলীয় সরকার ক্ষমতায়। নির্বাচনের সময় তাদের রুটিন কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেয়া উচিত। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তার আচরণ কি হবে, ভোটের আগে-পরে তারা কি করতে পারবেন তা চিহ্নিত করে দেয়া উচিত।

এ বিশ্লেষক বলেন- ইসিকে বুঝতে হবে, এটা জনগণের অফিস। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কি ব্যবস্থা নেয়া হল তা দৃশ্যমান হওয়া উচিত। ভোটসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিলে তা দূর করতে হবে। এসব কারণে ইসিকে আরও সক্রিয় হতে হবে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু আগে থেকে বিধি লঙ্ঘন রোধের ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। এটা করতে হলে সবার পেছনে লোক রাখতে হবে। সূত্র: যুগান্তর।

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: