টেলিফিল্ম কে আমরা ডিজিটাল ছবি বলে চালিয়ে দিচ্ছি

প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৫০ পিএম

চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে সুব্রত বড়ুয়াকে চেনেন না এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। আশির দশক থেকে সুব্রত বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় একজন অভিনেতা হিসাবে পরিচিত। তিনি তার দক্ষ অভিনয় দ্বারা বহু জনপ্রিয় ছবি উপহার দিয়েছেন।

বর্তমানে বেশ কিছু ছবির কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন এই অভিনেতা। আশির দশক থেকে সিনেমার সাথে যুক্ত হয়ে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন চলচ্চিত্রে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রির নানান অবস্থা দেখেছেন তিনি। ১৯৮৫ সালের দিকে প্রথম্বারের মত আয়োজিত ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ দিয়ে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে তার। এরপর থেকে অনবরত কাজ করে চলেছেন ঢাকাই সিনেমাতে।

এক সময় আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সোনালী দিন ছিলো। সিনেমার সেই সোনালী ইতিহাস গুলো এখন আর চোখেই পড়ে না। এখন কালেভদ্রে দুয়েকটা ভালো ছবি পাওয়া যায় বছর শেষে। কিন্তু সে সময়টাতে অনেক সিনেমার দেখা মিলেছে যেগুলো দেখতে দর্শকরা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত কিন্তু এখন আর তা দেখা যায় না। দর্শকরা এখন প্রায় হল বিমুখ। বর্তমান ও আশির দশকের দিকের ইন্ডাষ্ট্রির অবস্থা নিয়ে সুব্রত বড়ুয়া বিডি২৪লাইভের সাথে কথা বলেন। দীর্ঘ ৩৪ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি দেখেছেন অনেক কিছু। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যা পেয়েছেন বা দেখেছেন তা নিয়েই কথা বলেন তিনি।

তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে অনেকে আশাহত। কিন্তু আমি কখনোই আশাহত হই না এজন্য যে সবসময় একটা আশা নিয়ে থাকতে হবে, যদি আশা-ই না থাকে তাহলে আমরা কিন্তু এর প্রতিফলন পাবো না। সবসময় মানুষের জীবন তো আর একটা গতিতে চলে না। আজ থেকে দশ বছর আগে আমি যে গতিতে চলেছি আমার বয়স আর অভিজ্ঞতা দিয়ে এখন আর সে গতিতে চলতে পারবো না। আমি এখন কিন্তু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ! আমাকে আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিচালনা করতে হবে।

এক সময় আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক অনেক ছবি হতো কিন্তু এখন হচ্ছে না। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা ডিজিটাল ছবি বানাচ্ছি কিন্তু আমাদের হলটাই ডিজিটাল না তাহলে হবে কি করে! ছবি আমরা চালাবো কোথায়! প্রথম ভুল এটা আমাদের।

যখন ৩৫ ক্যামেরার যুগটা চলে গেলো আরও কাল হয়ে দাড়ালো আমাদের জন্য। এর কারণ হলো ডিজিটাল যে একটা শব্দ আসলো, আমরা অনেকে অনেক কিছু না বুঝেই কিছু না কিছু তৈরি করে ফেলছি। টেলিফিল্ম কে আমরা ডিজিটাল ছবি বলে চালিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু যে গল্পটা চালাচ্ছি কিন্তু গল্পটা ছবির মত হয় নি, গতিটা ছবির মত হয় নি কিন্তু আমরা ছবি বলে চালিয়ে দিচ্ছি। এই যে দর্শকরা একটা ধোকা খাচ্ছে এটা ডিজিটাল ছবি! এখানে কোন মজা নেই, কোন ফিল নেই।

এই যে দর্শক হল থেকে বেরিয়ে গেলো এই দর্শকগুলোকে আমাদের হলে ঢুকাতে আমাদের এখন পরিশ্রম, পরিশ্রম আর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। কিন্তু দর্শক তো হলে ঢুকছে না, তারা ধোকা টা প্রথমেই খেয়ে ফেলেছে। ডিজিটাল ছবি এমন হয়! আমার তো আগেই ভালো ছিলো যেগুলা দেখে হলে বসে শিস মারতাম, হাততালি মারতাম। কিন্তু এখন আমি আর আমাকে খুঁজে পাই না। আমি নেই এখানে। আমি যখন আমাকে খুঁজে পাবো না তখন তো আর আমি হলে যাবো না, হল বিমুখ হয়ে যাবো। এই একটা ভুলের জন্য খেসারত দিতে দিতে আমরা এই পর্যন্ত চলে এসেছি। এখন নতুন দর্শক সৃষ্টি, নতুন দর্শক কি চায়! তাদের মত করে আমাদের এখন চলতে হবে, সিনেমা বানাতে হবে। যারা ডিজিটাল জিনিসটা বুঝে, আধুনিকতাটা বুঝে তাদের জন্য তাদের মত করে এখন গল্প ও সিনেমা বানাতে হবে। কিন্তু সেই গল্পটা ধার করে নিলেই কিন্তু চলবে না। আমার, আমাদের আশেপাশে কিন্তু অনেক গল্প আছে সেখান থেকে গল্প তুলে নিয়ে আসতে হবে যেখানে আমি আমাকে পাবো, এখনকার দর্শক তাকে খুঁজে পাবে। সেই গল্পগুলো যদি আমরা তুলে আনতে পারি, এখনকার দর্শকদের মন মেজাজ যদি অনুধাবন করতে পারি তবে আমরা অবশ্যই আমাদের আগের জায়গায় আবার ফিরে যেতে পারবো।

যোগ করে তিনি আরও বলেন, সোনালী অতীত বলতে কিছু নেই। আমি বর্তমানটাকেই ভবিষ্যৎ ভাববো এবং ভবিষ্যতই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের মেধাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। এক সময় আমাদের অনেক মেধা ছিলো। আমাদের একসময় এমন পরিচালক বা প্রযোজকরা ছিলেন যারা মেধাগুলোকে নিয়ে আসতো যে ছবি বানান, গল্প বানান টাকা আমি দেবো। কিন্তু এখন মেধার এমন হীনতা অবস্থা, আমাদের এখানে যারা যা কিছু জানে তারা এখন প্রযোজক খুঁজতে যায়।

প্রযোজক খুঁজতে গেলে সেতো তাকে বাইন্ডিং দেবে। আমাকে কাজটা এভাবে করে দেন, ওভাবে করে দেন। কিন্তু আমি আমার মেধাটাকে খাটাতে পারছি না। আমি যখন আমার মেধাটাকে খাটাতে পারবো না তখন সেখানে নতুন কিছু সৃষ্টি হবে না। আপনার ধার করা ব্রেইন নিয়ে আমি চলছি, আপনার মেধাটা কাজ করছে আমারটা তো কাজ করছে না। আমার মেধাটা যদি কাজ করাতে না পারি তাহলে আমি পরিশোধিত হবো কি করে! আমার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হবে কি করে!

আমাদের অনেক গুণী নির্মাতা সুভাষ দত্ত, নারায়ণ, কাজী জহির বলেন আরো অনেক নির্মাতা ছিলেন যারা অনেক ছবি বানিয়েছেন। তারা তাদের প্রথম ছবিতেই অনেক ভালো করেছে তা কিন্তু নয়। তাদেরো ভুল ত্রুটি ছিল কিন্তু তারা সেগুলা থেকে শুধরে পরবর্তী ছবিগুলোতে মেধাকে কাজে লাগিয়েছে আর যার জন্য অনেক ভাল ও নতুন কিছু দিয়ে যেতে পেরেছেন ইন্ডাষ্ট্রিতে। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে ছবিগুলো দেখেছে তখন।

একজন পরিচালককে স্বাধীনতা দিতে হবে তার কাজটা করার জন্য। কিন্তু এখনকার প্রযোজকরা শুটিংয়ে এসে বসে থাকেন। তারা বলে দেন কিভাবে শট নিতে হবে। শটটা এভাবে নিলে হয় না, এটা এভাবে করলে হয় না! পরিচালক বা অভিনয় শিল্পীরা তখন বিব্রতবোধ করে। যে অভিনয় করে সে অভিনয় জানে বলেই সে একজন অভিনেতা আর যে ডিরেকশন দেয় সে সেটা জানে বলেই সে ডিরেক্টর। সো তাদেরকে সেই স্বাধীনতা টা দিতে হবে। যখন সেই স্বাধীনতাটা আমরা দিতে পারবো তাদেরকে তখন অনেক ভালো ছবি ও অনেক ভালো শিল্পীও তৈরি হবে তখন।

প্রসঙ্গত, সুব্রত বড়ুয়া ১৯৮৫ সালে মোহাম্মদ হান্নান পরিচালিত ‘রাই বিনোদিনী’ দিয়ে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তীতে একই পরিচালকের ‘মালা বদল’ ও ‘মাইয়ার নাম ময়না’ চলচ্চিত্র দিয়ে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেন।

বিডি২৪লাইভ/আইএন/আরআই

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: