আমি কখনো হিরো হতে চাই নি!

প্রকাশিত: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:৫২ পিএম

একজন জাত অভিনেতা ছিলেন হুমায়ুন ফরিদী। তাঁর রক্তে মিশে ছিলো অভিনয়। নাট্য জগতের সবাই বুঝে ফেলেছিল যে ধূমকেতুর জন্ম হয়েছে, একদিন শাসন করবে এই যুবক। সেদিনের হিসেব এক চিলতেও ভুল হয়নি, এরপর টানা তিন দশক তার ক্যারিশম্যাটিক, তার ম্যাজিকাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো বাঙালি অভিনয় প্রিয় জাতিকে। তিনিই আমাদের হুমায়ূন ফরীদি।

একজন হুমায়ুন ফরীদি বারবার জন্মায় না। তার মত শিল্পী জন্মাতে যুগ যুগ সময় লাগে, শতাধিক বছর লাগে। একজন প্রকৃত অভিনেতা মনে হয় তিনিই যিনি মঞ্চ , নাটক, সিনেমা- সব জায়গাতেই দক্ষতার সাথে অভিনয় করতে পারেন আর মানুষের মন জয় করতে পারেন। অভিনয়ের মাধ্যমে আমৃত্যু ছড়িয়েছেন জীবনের বর্ণীল আলো। অথচ তার ব্যক্তিজীবনটা ছিল পুরোটাই সাদামাটা। ঠিক সাত বছর আগে মাত্র ৬০ বছর বয়সে ফাল্গুনের এই প্রথম দিনটিতে সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন দেশের অগণিত মানুষের প্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি।

বাঙালির মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবনধারা কে তিনি আনন্দিত করে তুলেছিলেন, ফরিদীর নাটক মানেই বিটিভির সাদাকালো পর্দায় পুরো বাঙালির চোখ আটকে যাওয়া। হতাশ করতেন না তিনি! এতো প্রানবন্ত, এতো জীবন্ত, যেন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই জীবন্ত হয়ে যেতো ফরিদীর অভিনয়ে!

নব্বই দশকে এসে নাম লিখিয়েছিলেন ‘বানিজ্যিক ধারার বাংলা ছবিতে। ‘হুলিয়া ‘ দিয়ে প্রথম সিনেমাতে অভিনয়। ফরিদী অভিনয়ে এতোটাই অনবদ্য ছিলেন যে একসময় নায়কের চেয়ে বাংলা সিনেমা প্রেমী জাতির কাছে ভিলেন হুমায়ূন ফরিদী বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন। হলে তাঁর সিনেমা মুক্তি মানেই ওপচে পরা ভীড়! সেলুলয়েড়ের বিশাল পর্দায় ফরিদীর উপস্থিতি মানে দর্শকদের মুহুর্মুহু তালি। একটু একটু করে বাংলা সিনেমায় ভিলেনের সংজ্ঞাটাও যেন পরিবর্তন হতে থাকে। সেই দশকে এমন অবস্থা ছিল যে, দর্শক নায়ক নায়িকা না দেখে শুধু তাকে দেখার জন্যই হলে আসতো। পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন সম্ভবত এই কারণেই নিজের পরিচালিত ২৮ টি সিনেমার মাঝে ২৫ টিতেই ফরীদিকে রেখেছেন।

তখন হুমায়ূন ফরীদি নিজে বলেছিলেন, 'আমি কখনো হিরো হতে চাই নি! হিরো হওয়া তো সমস্যার! হিরোর কিছু নির্দিষ্ট কাজকর্ম করতে হয়, আমি সবসময়ই অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মানুষ ভালোবেসে মনে হয় আমার মতো মানুষকে হিরো বানিয়ে দিয়েছে। যেখানেই যাই, অসংখ্য লোক চলে আসে। প্রিয় জায়গায় যেতে পারিনা, কিছুটা বিরক্ত লাগে। তবে এই ভালোবাসা ভাল লাগে অনেক, একদিন সকালে উঠে যদি আমি দেখি মানুষ আমাকে চিনতে পারছে না, তাহলে এর চেয়ে বড় দুঃখ আমি আর কোন কিছুতে পাব না। আমি চাই যে মানুষ আমাকে চিনবে।'

একজন হুমায়ুণ ফরীদিকে আমরা হারিয়েছি। হয়তো আর কোন ফরীদিকে আমরা পাব না। খুব সাদামাটা জীবন যাপন করা মানুষটা সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা রয়েছে। তাঁর কিছু এখানে তুলে ধরা হলো...

স্থান , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকে স্থাপিত হওয়া একটি হল যেটার নাম 'আল বিরুনি হল'। হলের উপরে যেই অংশে হলের নাম লেখা থাকে, সেই অংশ থেকে হলের নামটি রোদ-বৃষ্টির কারণে মুছে গেল, 'আল বিরুনি' উধাও হয়ে গেল, রয়ে গেল শুধু 'হল'! ছাত্ররা অনেক অভিযোগ করলো, হলের নামটা নতুন করে লেখেন বা ঠিক করেন- যাদের কাছে অভিযোগ করা হলো, তারা তেমন কানে নিলেন না। আরে! সবাই তো জানেই যে এটা আল বিরুনি হল! এত ঠিক করার কি আছে? করব নে পরে-এমন একটা ভাব। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল যে বাঁকা করতে হয়- এই বুদ্ধি আসলো এই হলের একজন ছাত্রের মাথায়। গভীর রাতে গিয়ে তিনি একটি অদ্ভুত কাজ করলেন। পরের দিন সকালে সবাই দেখল, হলের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে “হুমায়ুন ফরীদি হল”। উপরের মহল তো রেগেই আগুন! কে করেছে এই কাজ? ফরীদিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নির্লিপ্ত গলায় বললেন- আপনারা তো ঠিক করলেন না, তাই আমিই ঠিক করে দিলাম! ফলাফল- এরপরেই হলের নাম ঠিক করে আবার “আল বিরুনি হল” রাখা হলো। আল বিরুনি হলের ক্যান্টিনে হুমায়ূন ফরীদির ৩১৯ টাকা 'বাকি' ছিল, এই বাকির কথা তাকে মনে করিয়ে দেয়া হলে তিনি বলতেন- আমি জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের কাছে ঋণী থাকতে চাই, এই ঋণ আমি শোধ করতে চাই না!

এরপর কুরবানি ঈদের সময়। হলের বেশিরভাগ ছাত্ররা বাড়িতে চলে গেছে। অল্প কয়েকজন হলে থেকে গেছে, কারণ ঈদের পরেই পরীক্ষা নামক ‘যন্ত্রণা’ শুরু হবে। এই ছাত্ররা দলবল মিলে গেল মরহুম প্রফেসর কলিমুল্লাহর বাসায়। হুমায়ুন ফরীদি বললেন- ‘স্যার! আমরা কয়েকজন ছাত্র হলে আছি, কুরবানির ঈদ স্যার, আমাদের একটা গরুর ব্যবস্থা করে দেন কুরবানি উপলক্ষে।’

স্যার বললেন- তোমরা কয়জন? আমরা ২০- ২২ জনের মত আছি স্যার- উত্তর এলো। তাহলে তোমাদের গরু লাগবে না, এক কাজ করো, আমি খাসির ব্যবস্থা করছি তোমাদের জন্য। ভগ্ন হৃদয়ে ছাত্ররা স্যারের বাসা ত্যাগ করল, তখনই স্যারের বাসার বাইরে কুরবানির জন্য কিনে এনে রাখা কালো গরুটা নজরে পড়লো। চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল ফরীদির সাথে বাকি সবার। সেদিন রাতেই স্যারের গরু চুরি করে নিয়ে আসলেন, সকালে সাভার থেকে কসাই নিয়ে আসলেন। দেড় মণের মত মাংস হলো, ফরীদি কসাইকে বললেন ১৫ কেজির মতো রান্না করেন আর বাকিটা রেখে দেন। এদিকে কলিমুল্লাহ স্যারের চক্ষু চড়কগাছ সকাল বেলায় নিজের গরুকে না পেয়ে! উপায় না দেখে সকালেই নয়ারহাট (সাভারের একটি বিখ্যাত বাজার এলাকা) থেকে গরু কিনের আনলেন, আর হলের ছেলেদের কাছে খবর পাঠালেন “তোমরা আমার বাসায় এসে সেমাই খেয়ে যেয়ো”। সেমাই খেতে যাওয়া বালকেরা খালি হাতে গেল না, বেঁচে যাওয়া গরুর মাংস সব নিয়ে গেল স্যারের বাসায়। স্যার বললেন- এগুলা কি? ফরীদি মুচকি হেসে বললেন- আমরা স্যার একটা গরু কিনেছিলাম, আমাদের খাওয়া শেষ, তাই ভাবলাম বাকিটা আপনার জন্য নিয়ে আসি। স্যার সব বুঝে গম্ভীর মুখে বললেন- হ্যাঁ হ্যাঁ! বুঝলাম! রাখো এই মাংস, আর খেতে বসো!

একদিন শীতের সময় হুমায়ুন ফরীদি অনেক রাতে নিজের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছেন। বিজয় সরণি মোড় পার হবেন, তখনই একটি দৃশ্য দেখে গাড়ি থামালেন। দেখলেন, একজন বৃদ্ধ মানুষ শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, তার পড়নে লুঙ্গি ছাড়া আর কিছুই নাই। হুমায়ুন ফরীদি নিজের কোট আর শার্ট খুলে ঐ বৃদ্ধকে পড়িয়ে দিয়ে আসলেন, বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। ফরীদি বাসায় ফিরলেন খালি গায়ে। এটা তো শুধু একটা উদাহরণ, সাভারে দুইটি এতিমখানা আছে যার যাবতীয় খরচ ফরীদি বহন করতেন, কেউ জানতো না যে ফরীদি দুইটি এতিমখানা চালাচ্ছেন। নিজের দানের কথা জানাতে বিরক্ত বোধ করতেন তিনি।

মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তুমুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শিল্প-সংস্কৃতিপ্রেমীদের হৃদয়ে আসন গেড়ে নেন। ১৯৬৪ সালে মাত্র ‪‎বারো‬‬‬‬ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জের মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক ‘ প্রথম অভিনয়ে করেন।

ছোটবেলায় ফরিদীকে ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্য ফরীদিকে ‘পাগলা’, ‘সম্রাট’, ‘গৌতম’-এমন নানা নামে ডাকা হত। ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্ম নেওয়া ফরিদীর প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে। মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল পাস দিয়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন। এলো একাত্তুর, চলে গেলেন যুদ্ধে। নয় মাসের যুদ্ধ পরে লাল-সবুজের পতাকা হাতে ঢাকায় ফিরলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ফেরেননি। টানা পাঁচ বছর বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়ে শেষে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনার্সে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল দীনের সংস্পর্শে আসেন। এই ক্যাম্পাসেই ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন ফরীদি। ছাত্রাবস্থায়ই ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হন। জড়িয়ে যান মঞ্চের সাথে।

দহন, আনন্দ অশ্রু, বিচার হবে, মায়ের অধিকার, একাত্তরের যীশু, ভন্ড, পালাবি কোথায়, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, হিংসা, বিশ্ব প্রেমিক, অপহরণের মতো জনপ্রিয় এবং একই সাথে বানিজ্যিকভাবে সফল ২৫০ টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন। অভিনীত সিনেমার মধ্যে ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘দহন,’ ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘কন্যাদান’ (১৯৯৫), ‘আঞ্জুমান’ (১৯৯৫), ‘দুর্জয়’ (১৯৯৬), ‘বিচার হবে’ (১৯৯৬),‘মায়ের অধিকার’ (১৯৯৬) ‘আনন্দ অশ্র“’ (১৯৯৭), ‘শুধু তুমি’ (১৯৯৭), ‘পালাবি কোথায়’, ‘একাত্তুরের যীশু’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’. ‘বিদ্রোহ চারিদিকে, ‘ব্যাচেলর’ (২০০৪), ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪), ‘রূপকথার গল্প’ (২০০৬), ‘আহা!’ (২০০৭), ‘প্রিয়তমেষু’ (২০০৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বিডি২৪লাইভ/আইএন/এসএস

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: