আগুন, আগুন, আগুন!

প্রকাশিত: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:৩৮ এএম

কেউ কেনাকাটায় বেরিয়েছিলেন। কেউ চিকিৎসকের চেম্বারে অপেক্ষায় ছিলেন। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ির পথও ধরেছিলেন কেউ কেউ। তাদের অনেকেরই আর ফেরা হয়নি। আচমকা আগুনে নিভে গেছে ৭০টি প্রাণ। পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ এ আগুনে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আরও প্রায় অর্ধশত।

নিমতলীতে আগুনের নয় বছরের মাথায় এর এক কিলোমিটারের মধ্যে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আবারও একই বীভৎস রূপ দেখল বিশ্ববাসী। রাসায়নিক থেকে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ ওই আগুনে মৃত্যু হয়েছিল ১২৪ জনের। এবার মৃত্যু ৭০ জনের।

বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টার দিকে চকবাজারের চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ সংলগ্ন আসগর লেন, নবকুমার দত্ত রোড ও হায়দার বক্স লেনের মিলনস্থলে ঘটে এ অগ্নিকাণ্ড। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট রাতভর চেষ্টা চালিয়েও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। পরে যুক্ত হয় পুলিশ ও র‌্যাব। এরপর বৃহস্পতিবার বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটানো হয়। দুপুরের দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।

কিন্তু দু’দিন বাদেই এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দেশের আরও কয়েক জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যা পুরো দেশের মানুষের জন্য একটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে মুদি সর্দার মসজিদের কাছে আগুন লাগে। রাত ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে সেখানে আগুনের সূত্রপাত হয়। নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটকে পাঠানো হয়। এরপর ওই তিন টিমের প্রচেষ্টায় কিছুক্ষণ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

এর আগে শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সাতটার দিকে ম্যানহোলের ভেতরে থাকা লাইনের লিকেজ থেকে বের হতে থাকা গ্যাসে আগুন লেগে রাজধানীর জুরাইনের আইজি গেট এলাকায়।

গ্যাস বের হওয়ার কারণে আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই বাসা এলাকা ছেড়ে আশপাশে আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পোস্তগোলা স্টেশন থেকে দেলোয়ার হোসেন নামে একজন ফায়ার সার্ভিসকর্মী টেলিফোনে জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন তারা। স্থানীয়রা তাৎক্ষণিকভাবেই আগুন নিভিয়ে ফেলেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা স্টেশনে ফিরে আসেন।

এছাড়া শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টায় চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শেখেরখিলের মোলভীবাজার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে একটি বাড়ি ও দোকান। এতে অনেক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত গ্যাসের চুলা থেকে ঘটেছে বলে জানা যায়।

আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট। এতে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি।

তাছাড়া শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাত পৌনে ৯টায় কুমিল্লায় শহরের মুন হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগার পর হাসপাতালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ ঘটনায় কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

রাত ৯টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে কুমিল্লা ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আবু রায়হান একটি গণামাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, হাসপাতালটিতে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। হাসপাতালের ৯ তলায় একটি ল্যাবে আগুন লাগে। রাত ৯টা ৫ মিনিটে সেটি নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার ফাইটাররা।

এছাড়াও দেশের আরও বেশকিছু জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

চুড়িহাট্টার যে ভবনগুলোতে আগুন লেগেছে তার মাঝে একটি গোল চত্বরের একপাশে জড়ো করে রাখা হয়েছে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাড়ি, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের অবকাঠামো।

এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পেছনে সম্ভাব্য তিনটি কারণ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, আমরা ঘটনাস্থল থেকে অনেক ক্লু পেয়েছি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনটি কারণে আগুন লাগতে পারে। এগুলো হচ্ছে- ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও কেমিক্যাল বিস্ফোরণ।

শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

শামসুল আলম বলেন, আমরা পুড়ে যাওয়া কয়েকটি গাড়ি চেক করেছি। অনেকেই দুর্ঘটনাস্থলে থাকা যেই পিকআপটির সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাতের কথা বলেছিল; কিন্তু সেই পিকআপের সিলিন্ডারটি অক্ষত অবস্থায় আছে।

তিনি আরও বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, এ এলাকায় বেশ কিছু কেমিক্যালের দোকান রয়েছে। এ ছাড়া ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচে বেশকিছু প্লাস্টিকের দোকান ছিল। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটির সদস্য বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার বিম ও কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের সাপোর্ট ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।

এরই মধ্যে পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে সরকারি সংস্থার কোনো অবহেলা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমিটি এ কথা জানায়।

অগ্নিকাণ্ডের উৎস খুঁজে বের করা ও ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করে সরকারকে সুপারিশ দেওয়ার জন্য এই পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের আগুন থেকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে।

আগুন নিয়ন্ত্রণ নয়, প্রতিরোধ করুন: আমাদের দেশের অধিকাংশ বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুন লাগার পর তা কিভাবে নেভানো হবে, সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেন। যদিও বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত আগুন লাগার আগেই। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা পাওয়া সহজ নয়। কারণ রাস্তায় জ্যাম লেগেই থাকে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন স্থানের সংকীর্ণ রাস্তাঘাট। ফলে দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানো সম্ভব হয় না। বড় বিপণী বিতান বা আবাসনে আগুন লাগলে তা কিছুক্ষণ পর নেভানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই আগুন লাগলে তা কিভাবে নেভানো হবে তার একটি পরিকল্পনা আগেই করে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা ও আগুন শনাক্ত ও নেভানোর যন্ত্রপাতি এবং সেগুলো চালানোর মতো প্রশিক্ষিত জনবল থাকা প্রয়োজন।

আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণ:

১। জ্বলন্ত সিগারেটের শেষাংশ, ম্যাচের কাঠি বন্ধ না করে যেখানে-সেখানে ফেলা।

২। ছুটির পরে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ- যেমন কম্পিউটার, ইউপিএস, বৈদ্যুতিক কেটলি, ফটোকপিয়ার বন্ধ না করে চলে যাওয়া।

৩। চুলা বন্ধ না করে চলে যাওয়া।

৪। বৈদ্যুতিক লুজ কানেকশোন, ঝুলন্ত/লিক তার ইত্যাদির ফলে শর্ট সার্কিট।

৫। বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, জেনারেটর ইত্যাদি থেকে অতিরিক্ত তাপ সৃষ্টি হওয়া।

৬। গাড়ি/ অন্য কোন ইঞ্জিনের মিস ফায়ার থেকে।

৭। লিফট/ অন্য কোন মেশিনের অতিরিক্ত ঘর্ষণের থেকে।

কিছু সতর্কতা সর্বদা মেনে চলুন:

এক সাক্ষাৎকারে ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন্স এন্ড মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, বাংলাদেশে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন, ফ্যাক্টরি সবক্ষেত্রেই আগুন মোকাবেলায় পূর্ব প্রস্তুতি এবং তড়িৎ পদক্ষেপের ঘাটতি দেখা যায়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনায় স্থাপিত অগ্নি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘দেখা যায় নামে মাত্র টিম রয়েছে যাদের কোনো প্রফেশনাল ট্রেনিং নাই, ইক্যুইপমেন্ট নাই, পারসোনাল প্রটেকশন গিয়ার নাই। অনেক বিল্ডিংয়ে ফায়ার ইক্যুইপমেন্ট লাগানো হয়েছে কিন্তু ঠিকভাবে মেইনটেনেন্স করা হচ্ছেন না। আবার লোকজন জানেও না কিভাবে এটা ব্যবহার করতে হবে’ বলেন মেজর শাকিল নেওয়াজ।

অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য কিছু নির্দেশনা:

১। অগ্নি প্রতিরোধে সচেতন হোন।

২। রান্নার পর চুলার আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলুন।

৩। বিড়ি-সিগারেটের জলন্ত অংশ নিভিয়ে নিরাপদ স্থানে ফেলুন।

৪। ছোট ছেলেমেয়েদের আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত রাখুন।

৫। খোলা বাতির ব্যবহার কমিয়ে দিন।

৬। ক্রটিযুক্ত বা নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার, ফিটিংস ও সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

৭। বাসায়, অফিসে বৈদ্যুতিক তার ও ওয়ারিং মাঝে মাঝে অভিজ্ঞ ইলেকট্রিশিয়ান দ্বারা পরীক্ষা করাতে হবে।

৮। সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় হাতের কাছে সব সময় দু’বালতি পানি বা বালু মজুদ রাখুন।

৯। বাসগৃহ, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপনী যন্ত্রপাতি স্থাপন করুন এবং মাঝে মাঝে সেগুলির কার্যকারিতা পরীক্ষা করুন।

১০। প্রতিটি শিল্পকারখানায়, সরকারি ও বেসরকারি ভবনে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ও বিধি অনুযায়ী অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করুন।

১১। কলকারখানায় অগ্নি নির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখুন।

১২। গুদাম বা কারখানায় ধুমপান নিষিদ্ধ করুন ও দৃশ্যমান স্থানে সতর্কীকরণ পোষ্টার প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিন।

১৩। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স হতে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন বিষয়ক মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন।

১৪। স্থানীয়ভাবে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপনের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলুন।

১৫। যে সকল কারণে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয় সে সব কারণ থেকে সাবধানতা অবলম্বন করুন।

আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের সেবা চাইতে ৯৯৯ নম্বরে কল করুন। নম্বরটি প্রয়োজনীয় সব স্থানে লিখে রাখুন। শুধু অগ্নিকাণ্ড নয়, ফায়ার সার্ভিস আরও নানা ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে। যেমন সড়ক দুর্ঘটনা, নৌ দুর্ঘটনা, আটকে পড়া মানুষ বা পশু-পাখি উদ্ধার ইত্যাদি।

বিডি২৪লাইভ/এইচকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: