নতুন ক্ষমতা আর আমাদের জন্য নতুন দায়িত্ব!

প্রকাশিত: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৩৪ পিএম

বেশ কিছুদিন আগে এক এনজিও কর্মকর্তার সাথে কথা হচ্ছিলো। তাঁর কাজের প্রসঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন, তাঁরা এই দেশের সাংবাদিকদের লিখার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। একটি রিপোর্টে কি লিখা উচিত আর কি লিখা উচিত না সেগুলোই তাঁদের প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু। ব্যাপারটি আরেকটু বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বললেন, সব ভাষাতেই এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলো পাঠকরা পড়তে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না। সেই শব্দগুলো পড়লে পাঠক মানসিক ভাবে আঘাতপ্রাপ্তও হতে পারেন। উন্নত বিশ্বে বিষয়টি এত গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় যে সেখানে পাঠক এসকল ক্ষেত্রে সংবাদ পত্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা পর্যন্ত গ্রহণ করে থাকেন।

এনজিও কর্মকর্তার কথা শুনে উপলব্ধি হয়েছিলো সাংবাদিকতা কাজটি আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার এই কাজের অনেক বড় একটা ক্ষমতাও আছে; যেকোনো সংবাদ পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতার পেছনে সক্রিয় থাকে এক বিশাল দায়িত্ববোধ।

স্পাইডারম্যান সিনেমার একটা সংলাপ আমার খুব মনে ধরেছিল; ‘Great power comes with great responsibility’। এই কথাটির সঙ্গে আমার ধারণার অবশ্য কিছুটা ভিন্নতা আছে। আমার মতে আসলে সব ধরনের ক্ষমতার সাথেই দায়িত্বের ব্যাপারটি চলে আসে। যার ক্ষমতা সীমিত, তার দায়িত্ব কম। আবার যার হাতে ক্ষমতা বেশি তার দায়িত্বও বেশি। বর্তমান সময়ে আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি তারাও এ দায়িত্বের ঊর্ধ্বে নই। সোশ্যাল মিডিয়াও মানুষের জন্য এক বিরাট ক্ষমতা।

আমার ছোটবেলার একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই। আমি যখন অনেক ছোট, তখন আমার বাবা বিদেশ থাকতেন। প্রবাসীদের দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে তখন পত্র যোগাযোগ। অতীব জরুরী হলে টেলিগ্রাফ এবং সুবিধা থাকলে টিএন্ডটি’র ফোন। বলাবাহুল্য, যে ওই সময় খুব কম বাড়িতেই টিএন্ডটি’র ফোন ছিলো। এটা ৮৫ কিংবা ৮৬ সালের কথা। আমার দাদি বলতেন, আমার বাবার সাথে কথা বলার জন্য তাঁকে নির্দিষ্ট দিনে এবং নির্দিষ্ট সময়ে পাশের বাড়ীতে যেয়ে অপেক্ষা করতে হতো। কোনো কারণে ওই দিন লাইন পাওয়া না গেলে পুত্রের কণ্ঠে সুমধুর ‘মা’ ডাকটি শোনার জন্য তাঁর অপেক্ষা প্রলম্বিত হতো পরের সপ্তাহ পর্যন্ত। ঘটনাক্রমে, ২০০৮ এ পড়াশোনার জন্য আমাকেই বেশ কয়েক বছরের জন্য বিলেতে যেতে হয়েছিলো। সে সময়ে দেশে মা’র সাথে কথা হতো প্রায় প্রতিদিন। মন চাইলেই ফোন, প্রতিদিনের আপডেট। শুধু কথা নয় ভিডিও কল দিয়ে আবার দেখাও যেতো। মনে হতো, মা যেনো কাছেই বসে আছেন। স্কাইপ এর মতো সোশ্যাল মিডিয়ার কারণেই তখন তা সম্ভব হয়েছিলো।

স্কাইপের থেকে বর্তমানে আরো একধাপ এগিয়ে ফেসবুক। কথা বলার পাশাপাশি দেখাও যায়। আবার কখন কী করছি, কোথায় যাচ্ছি, লাইভ; সবকিছু মিলিয়ে এ এক বিশাল ব্যাপার! এ যেনো সারা পৃথিবী চোখের সামনে!

বিশেষজ্ঞরা ফেসবুককে এক নতুন গণতন্ত্র বলেও আখ্যায়িত করছেন ইদানিং। কেন নয়? চাইলেই মনের সব ক্ষোভ, আনন্দ, সমস্যা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা যাচ্ছে। শুধু ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় বিষয়াদিসহ বিশ্বের যেকোনো খবর মুহূর্তেই হাতের মুঠোয়। এই নতুন গণতন্ত্রে সামাজিক অসংগতি বা জাতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য বেশ কিছু সফল আন্দোলনের দৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক ক্ষতিকর দিক নিয়ে উদ্বিগ্নতাও বর্তমানে কম নয়। আসলে সকল ক্ষমতাকে-ই ভালো এবং মন্দ দুইভাবেই ব্যবহার করা যায়। ফেসবুকের মাধ্যমে যেমন অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে, আবার এই ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে অনেকের অনেক ক্ষতিও হয়েছে। বিদেশি অনেক কোম্পানিতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারবিধি নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখানে শিখানো হয়, ফেসবুকে কি লিখা উচিত। কোন ধরনের জিনিস শেয়ার করা উচিত আর কোন ধরনের জিনিস শেয়ার করা উচিত নয় সেগুলোও শিখানো হয়।

কমিউনিকেশনস এর মূল হলো অডিয়েন্স বুঝে মেসেজ দেয়া। ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়াতে আমার শেয়ার করা মুহূর্তটি কে বা কারা দেখছে বা পড়ছে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে মাথায় রেখে আমাদের কন্টেন্ট পোস্ট করা উচিত। আবার যা লিখছি তার শব্দ চয়নেও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারন লিখাটা যিনি পড়ছেন অথবা ছবিটি যিনি দেখছেন তার অনুভূতি কী হতে পারে তা অনুধাবন এবং বিবেচনা করার দায়িত্বটা আসলে যিনি লিখছেন অথবা ছবি দিচ্ছেন তার উপরই বর্তায়।

অনেক বিষয় যেমন মানুষকে ভালোলাগার অনুভূতি দেয় ঠিক তেমনি এমন অনেক বিষয় আছে যা অন্যকে কষ্টও দেয়। আমাদের লিস্টে থাকা বন্ধুদের কথা ভেবেই আমাদের আরও দায়িত্বশীলভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা উচিত। অন্যের প্রতি এমনকি সমাজের প্রতি মঙ্গল কামনা থেকেই আমাদের সবার সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সতর্ক হওয়া দরকার।

আজ থেকে দশ/বারো বছর আগেও ফিল্ম ক্যামেরাতে ছবি তোলা হতো। একটি রিল এ ৩০ থেকে ৩৫ টির মত ছবি উঠতো। সেগুলো থেকে ১৫/২০ টি বাছাই করা ছবি শুধু প্রিন্ট করে এ্যালবামে সংযুক্ত করা হতো। পরবর্তীতে বাসার সবাই মিলে আয়োজন করে সেই এ্যালবাম দেখা হতো। এখন আর সেরকম হয় না। ফেসবুকে সবাই শত শত ছবি দিচ্ছেন আর যে যার মত দেখে লাইক দিয়ে যাচ্ছেন। কি জানি, এই পন্থার হয়তো ভালো দিকও আছে ! এটা না থাকলে হয়তো এখনকার এই ব্যস্ত সময়ে অন্য কারোও ছবি দেখা হয়ে উঠত না!

অনেক সময় না বুঝে না জেনে বিচার বিবেচনা ছাড়াই আমরা একটি তথ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার দিয়ে থাকি। তরমুজে রং পুশ করার ঘটনার মতো ভিত্তিহীন সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে গিয়ে নতুন এক বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। আমরা যারা এরকম তথ্য শেয়ার করি, তাঁরা একবারও ভেবে দেখি না যে তরমুজ-এ আসলেই সিরিঞ্জ দিয়ে রং পুশ করা যায় কিনা? আর যদি যায়ও, তাহলে দেশের সর্বমোট উৎপাদিত তরমুজে রং পুশ করতে, কী পরিমাণ সময় আর কী ধরনের সুঁই সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে কিংবা কী বিশাল জনবল প্রয়োজন হবে সে বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার।

গত তিন দশকে প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়েছে। যা আমাদের জীবনকে করেছে সহজ আর আনন্দময়। দূরত্ব এখন আর কোন বাঁধা নয়। হাতের মুঠোয় সবকিছু! যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে যে কারো সাথে এখন যোগাযোগ করা সম্ভব। আমাদের জীবন হয়েছে গতিশীল, সৃজনশীলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। সোশ্যাল মিডিয়া আর প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা অনেক দুর এগিয়েছি। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে এর নেতিবাচক ব্যবহার যেন আমাদের কে আবার পিছিয়ে না নেয়। এই মহান ক্ষমতার শুধুমাত্র দায়িত্বশীল ব্যবহারই আমাদের জীবনে আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারে।

লেখক: আরিফুর রহমান স্বাক্ষর, হেড অব ডিজিটাল মিডিয়া, স্টারকম বাংলাদেশ

বিডি২৪লাইভ/আরআই

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: