ঐতিহাসিক দিবর দিঘি

প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০৪:০৫ পিএম

অতীতের সংস্কৃতি উদ্ধারে দেশের পুরাকীর্তির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। লিখিত ইতিহাসে যখন প্রাচীন ইতিহাসের কোন উপাদান অনুপস্থিত তখন সেখানে এই পুরাকীর্তির কিংবদন্তী উপকথা, প্রবাদ ইত্যাদির সাহায্যে প্রাচীন ইতিহাস পুনঃনির্মান করা হয়। পৃথিবীর অনান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস এখনো অন্ধকারছন্ন। এর মাঝেও স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ও স্যার বুকানন হ্যামিলটনের পরিদর্শন করা নওগাঁ জেলার পত্নীতলা থানার দিবর দীঘিতে অবস্থিত ‘দিব্যক জয়স্তম্ভ’ আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।

ঐতিহাসিক দিবর দীঘিটিতে স্থাপিত প্রাচীন স্থাপত্য পুরাকীর্তির অনুপম নিদর্শন এবং হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ও বাঙ্গালীর শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসাবে আজও দন্ডায়মান ‘বিজয় স্তম্ভটি’ দেখবার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী দিবর দীঘিতে ভিড় জমাচ্ছে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই দিবরদীঘিটি জেলা সদর হতে প্রায় ৫৮ কিঃমিঃ দূরে দিবর ইউপির পত্নীতলা সাপাহার পাকা সড়কের দিবর ব্রীজের মোড় হতে উত্তরে মাত্র দেড় কিঃমিঃ ভিতরে।

দীঘিটিকে ঘিরে লোক মুখে অনেক কাল্পনিক গল্প কথা প্রচলিত আছে। গ্রাম প্রধান ব্যক্তিদের মতে জনৈক বিষ্ণকর্মা কর্তৃক একরাতে এবং অন্যদের মতে জীনের এক বাদশার নেতৃত্বে এক রাতে বিশাল এই দীঘিটি খনন করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

তবে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ও লালিত ঐসব গল্পের কোন ভিত্তি নেই। এলাকাবাসীর কাছে ‘কর্মাকারের জলাশয়’ বা দিবর রাধীবর নামে পরিচিত এই দীঘিটি ৬০ বিঘা বা প্রায় অর্ধ বর্গমাইল বৃহৎ জলাশয়ের মাঝখানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই স্তম্ভটি।

স্তম্ভটির সঠিক ইতিহাস জানা কোন লোক বর্তমানে জীবিত না থাকলেও দীঘির পাড়ে দীঘির ইতিহাস সমৃদ্ধ সাইনবোর্ড লাইব্রেরী ও ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে একাদশ শতাব্দীতে কৈবর্ত্য রাজা দিব্যক তাঁর ভ্রাতা রুদ্রক ও রুদ্রকের পুত্র প্রখ্যাত নৃপতি ভীমের কীর্তি হিসাবে পরিচিত এই স্তম্ভটি। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে আরো জানা যায় পাল রাজা দ্বিতীয় মহিপালের (১০৭০-১০৭১খ্রিঃ) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বরেন্দ্র ভূমির ধীবর বংশদ্ভত কৃতি সন্তান দিব্যকের নেতৃত্বে পাল শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। সেই সাথে হত্যা করেন দ্বিতীয় মহিপালকে। পরে দিব্যকের সর্বসম্মতিক্রমে বরেন্দ্রের অধিপতি নির্বাচন করা হয়। কিছুদিন পরে দিব্যক মৃত্যুবরণ করলে প্রথমে রুদ্রক ও পরে রুদ্রক এর পুত্র ভীম সিংহাসনে আরোহন করেন। এই তিন কৈবর্ত্য রাজা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, আজ অবধি তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে এই ‘দিব্যক জয়স্তম্ভটি’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে তিনটি বিবরণ পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় মহিপালকে পরাজিত ও হত্যা করার সাফল্যকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যে দিব্যক এই জয়স্তম্ভটি বা স্তম্ভটি নির্মাণ করেন। দুই দিব্যকের রাজত্বকালে পাল যুবরাজ রাম পাল বরেন্দ্র উদ্ধারের চেষ্টা করে দিব্যকের কাছে পরাজিত হন। আর দিব্যক তাঁর এই সাফল্যের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দীঘির মাঝখানে এই স্তম্ভটি নির্মাণ করেন। তিনি ভীম এই স্ততম্ভটি নির্মাণ করেন এবং পিতৃব্য দিব্যকের স্মৃতি রক্ষার্থে স্তম্ভটি নির্মাণ ও তার নামে উৎসর্গ করেন।

দীঘিটির মাঝখানে অবস্থিত স্তম্ভটি গ্রানাইট পাথরের কোন বৈশিষ্ঠ্য আর একেকটি কোন একটি কোন থেকে অপরটি ১২"ইঞ্চি। এই বিরাট স্তম্ভের উপরিভাগে পরপর তিনটি বলয়াকারে স্ফীত রেখা আছে যা স্তম্ভটির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে আরো দ্বিগুন। এর শীর্ষ দেশে রয়েছে নান্দনিক কারুকার্য যা ব্যবহৃত মুকুট আকারে নির্মিত। এর পানির উপরের স্তম্ভটির উচ্চতা ১০ ফুট, পানির নিচে ১২ ফুট, এবং মাটির নিচে আরও ৮/১০ ফুট গ্রথিত আছে।

স্যার বুকানন হ্যামিলটনের মতে স্তম্ভটির সর্বমোট দৈর্ঘ্য পৌনে একত্রিশ ফুট এবং স্যার কানিংহামের মতে ৩০ ফুট। ১৮৭৯ সালে যখন কানিংহাম এই দীঘি পরিদর্শন করেন তখন এর গভীরতা ছিল ১২ ফুট এবং প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ফুট। বর্তমানে দিবর দীঘির জলাশয়ের পরিমান প্রায় ২০ একর। এর শীর্ষদেশের কিছু অংশ ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। কথিত আছে যারা এই কাজ করেছে তারা প্রত্যেকে দীঘির পানিতে ডুবে মারা গেছে। যুগ যুগ ধরে দীঘির পাড়ে প্রতি বছর চৈত্র মাসের কোন এক দিন হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্ষাবরণ মেলা বসে। 

বর্তমানে দিবর ইউনিয়নের উদ্দোগে দীঘিতে দর্শনার্থীদের আগমন বাড়াতে কয়েক বছর যাবৎ প্রতি বছর দুই ঈদের দিন থেকে পরবর্তী ৭ দিন মেলার আয়োজন করা হয়। এতে করে ঐ দুই মেলার সময় সহ অন্যান্য সময়ে বনভোজন ও ভ্রমনের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষের সমাগম ঘটে। এদিকে প্রকৃতির অপরুপ নয়নাভিরাম এই দীঘি চতুর্দিকে ‘রাজশাহী সামাজিক বন বিভাগ’ কর্তৃক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে লাগানো হয়েছে বিশাল বন। যা এই দীঘির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ছায়া সুশীতল মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। 
ঐতিহাসিক এই দিবর দীঘিতে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হলে এখানে প্রচুর লোকের সমাগম হবে এবং এতে সরকারী রাজস্ব বাড়বে। হাজার বছরের বাংলা ও বাঙ্গালীর সাংস্কৃতি ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসেবে কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে দন্ডায়মান এই স্তম্ভটির স্মৃতি ধরে রাখায় এখনি সরকারী পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।

বিডি২৪লাইভ/আরআই

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: