শবে বরাতের রুটি কেয়ামতের দিন ছায়া হবে, কথাটি কি সহিহ?

প্রকাশিত: ২০ এপ্রিল ২০১৯, ১১:২৬ পিএম

মাওলানা মনযূরুল হক : আগামীকাল রবিবার (২১ এপ্রিল) পবিত্র শব-ই-বরাত বা লাইলাতুল বরাত। শাবান মাসের ১৫ তারিখে শবে বরাতের রাত্রী বলে ঘোষণা করা হয়। শব শব্দটি ফার্সি যার অর্থ রাত আর বরাত শব্দের অর্থ ভাগ্য। বিশেষ এ রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা আগামী এক বছরের জন্য মানুষের রিজিক, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণসহ তার সৃষ্ট জীবের ওপর অসীম রহমত নাজিল করে থাকেন বলে এ রাতকে শবেবরাত বা ভাগ্যরজনী বলা হয়।

আমাদের সমাজে এই দিনটি মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। হালুয়া-রুটি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। সেই সাথে আরো এমন কতক কুসংস্কার দেখা যায়, যার সাথে ইসলামের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ মুসলমান হিসেবে আমাদের জেনে রাখা উচিত একাজগুলো কতটুকু ইসলাম সমর্থিত।

রুটিতে ছায়া মিলবে! : আমাদের গ্রামে-গঞ্জের নারীরা বলে থাকেন, এমনিক বহু শহুরে শিক্ষিত মেয়েদের মুখেও শোনা যায়, রাসুল (সা.) বলেছেন, শবে বরাতে রুটি বানিয়ে খেলে আল্লাহ তায়লা তার আরশের নীচে ছায়া দেবেন। কেউ কেউ বলেন, হাদিসে আছে, কেয়ামতের কঠিন দিনে রুটি বড় হয়ে বান্দার মাথার ছাতা হবে। যেহেতু ‘রাসুল (সা.) বলেছেন’ কিংবা ‘হাদিসে আছে’ বলা হয়, তাহলে বোঝাই যায়, এ কথা হাদিসে বর্ণিত আছে। অথচ সত্যি কথা হলো, রাসুলের (সা.) অজস্র হাদিসের কোথাও এমন কোনো বাক্যের উল্লেখ নেই। হাদিসের বর্ণনার সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। সুতরাং নির্দ্বধায় বলা যায়, কথাটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন, জাল ও বানোয়াট। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার চেয়েও বড় কথা হলো, জাল হাদিস লেখা বইপত্র কিংবা জাল হাদিস সম্পর্কিত কিতাবাদিতেও এর খোঁজ পাওয়া যায় না। (ইহয়াউ উলুমুদ্দীন, আল মাউযূআত) হালুয়া-রুটি খাওয়ার কারণ : যারা এমন জাল কথা বলেন, তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, শবে বরাতের রুটি কেনো এমন বরকতময় হলো? তখন তাদের বলতে শোনা যায়, ওহুদ যুদ্ধে রাসুলের (সা.) দাঁত মোবারক শহিদ হলে পরে কিছুদিন তিনি কোনো শক্ত খাবার খেতে পারতেন না। তখন তাকে চালের নরম রুটি ও হালুয়া করে খাওয়ানো হয়। আল্লাহ তায়ালা তা-ই শবে বরাতের এই দিনে হালুয়া রুটি খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কী আশ্চর্যের কথা! ওহুদ যুদ্ধের সাথে শবে বরাতের সম্পর্ক কী? ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে শাওয়াল মাসের ৭ তারিখে, আর শবে বরাত হয় শাবান মাসের ১৫ তারিখে। সুতরাং যদি তেমন কোনো বিষয় হতো তাহলে তো তা শাওয়াল মাসের ৭ তারিখে হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত হতো, শাবানের ১৫ তারিখে নয়। দ্বিতীয়ত হলো, রাসুল (সা.) যদি দাঁত ব্যথার কারণে নরম খাবার খেয়ে থাকেন, তবে কি তা তিনি শুধু একদিন খেয়েছিলেন? অবশ্যই একদিনে ব্যথা সেরে যায় নি। তাহলে এ কেমন রীতি হলো? অনেকে আবার হালুয়া-রুটির সাথে গরুর গোস্তও খেয়ে থাকেন, তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়ালো?

হালুয়া-রুটির ইতিহাস : কিন্তু এই রাতের সঙ্গে হালুয়া-রুটির বিষয়টি এলো কোত্থেকে। তার পিছনে ইতিহাস রয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ববর্তী যুগে এখনকার মতো মুসাফির যাত্রীদের থাকার জন্যে আবাসিক হোটের-মোটেলের ব্যবস্থা ছিলো না। তখন পথচারীদের বিশ্রামের জন্যে ছিলো সরাইখানা কিংবা মুসাফিরখানা। সফর অবস্থায় প্রয়োজনে মানুষ সেখানে রাত্রিযাপনও করতেন। আর এখানকার দায়িত্বশীল যারা ছিলেন, তারাই মুসাফিরদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। তো কোনো মুসাফির পবিত্র শবে বরাতে এসব স্থানে রাত্রি যাপন করলে হয়তো তিনি সারারাত ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন ও পরের দিন রোযা রাখতেন। যেহেতু স্বাভাবিকভাবে হালুয়া-রুটি ও গোশত-রুটি খাওয়া সুন্নাত, তাই তারা হালুয়া, রুটি, গোশত ব্যবস্থা করতেন সচরাচর। এছাড়াও আরব এলাকার লোকদের প্রধান খাদ্য রুটি-হালুয়া বা রুটি-গোশত। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটির প্রচলন আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে। (আত্‌তাহযীর মিনাল বিদা)

হালুয়া-রুটি খাওয়া কি নাজায়েয? : প্রশ্ন হতে পারে- কেউ যদি আরশের ছায়া জাতীয় কোনো ভুল ধারণা না রেখে বা নিজের ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে শবে বরাত উপলক্ষে এ ধরনের হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা করে, তাহলে কি তা না জায়েয হবে? উত্তর হলো, না, কিছুতেই নয় । উপরন্তু কেউ যদি ইবাদত গুজার বান্দাদের ইবাদত-বন্দেগি ও রোযা পালনের সুবিধার্থে হালুয়া-রুটি অথবা আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো খাবারের ব্যবস্থা করে, তাহলে তা অবশ্যই অশেষ ফজিলত ও সাওয়াবের কারণ হবে। হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা সালামের প্রচলন করো, মানুষকে খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার সর্ম্পক রক্ষা করো এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়ো তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ) আমাদের উচিত ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজ থেকে বিরত থেকে এ রাতের যে ফজিলত আছে, সে অনুযায়ী আমল করা। 

বিডি২৪লাইভ/এআইআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: