ডিজিটাল মাধ্যমে লাভবান কোম্পানি, শূন্যের কোটায় শিল্পীরা

প্রকাশিত: ২২ এপ্রিল ২০১৯, ০৬:২৬ পিএম

সাম্প্রতিক সময়ে সংগীতাঙ্গনে যেমন এসেছে বিরাট পরিবর্তন তেমনি গান শোনার মাধ্যমেও এসেছে আমুল পরিবর্তন। অনেকেই যেটাকে বলছেন ‘ডিজিটাল গানের যুগ’। কিন্তু একটা সময় ক্যাসেট প্লেয়ারে করে গান শোনার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। নব্বই দশকের দিকে ফিতার ক্যাসেটে গানের আলবাম প্রকাশের যুগটা শ্রোতাদের মনে এক অন্যরকম দাগ কেটে ছিল। যুগের পরিবর্তনে ক্যাসেট প্লেয়ারের পরে এলো সিডি পেয়ারের যুগ। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় ক্যাসেটের যুগ। বছর কয়েক চলার পর সেই সিডি প্লেয়ারের যুগটাও জায়গা করে নিল ইতিহাসের পাতায়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শুরু হলো অনলাইনে গানের প্রকাশনা।

বর্তমানে ক্যাসেট বা সিডিকে ছাড়িয়ে এক বিশাল জায়গা করে নিয়েছে অনলাইনের যুগ। এই যুগে আর ফিতা কিংবা সিডিতে গান প্রকাশ হয় না, হয় অনলাইনে। ইউটিউব, ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে শ্রোতারা যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে খুব সহজেই উপভোগ করতে পারছেন সেইসব গান। সেইসাথে মুঠোফোনের অ্যাপ্লিকেশন এর কারণে আরও বদলে যাচ্ছে শ্রোতাদের গান শোনার অভ্যাস। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের জিপি মিউজিক, রবির ইয়ন্ডার মিউজিক, বাংলালিংকের বিএল ভাইব এর কথা বেশি উল্লেখ করেন শ্রোতারা।

সেই দশকে শাহবাগ, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলি কিংবা পল্টনে ছিল ক্যাসেটের দোকান। প্রায় সব বাড়িতেই ক্যাসেটের দেখা মিলতো কিন্তু এখন তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তখন নতুন কোন অ্যালবাম প্রকাশের সাথে সাথে ক্যাসেট বা সিডির দোকানে শ্রোতাদের ভিড় জমতো। দোকানগুলোতে দেখা যেত চড়া ভলিউমে গান বাজাতে। কিন্তু এখন তো আর সেই যুগ নেই, অনেক দোকানে আর সেসব ক্রেতার তো দেখা নেই। যেখানে আগে প্রতিদিন দুইশত থেকে আড়াইশত ক্যাসেট বা সিডি বিক্রি হত এখন তো সেটা নেই বললেই চলে।

নব্বই দশকে ক্যাসেটে গান শোনার জোয়ার ছিল। দেশীয় সংগীত ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল এই মাধ্যমটি। বিভিন্ন রঙ বেরঙের মোড়কে কাভার ক্যাসেটে গান শোনার মাধ্যমে ব্যবসা সফলের দিকে সর্বোচ্চ অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল সংগীত জগত। সেসময় সংগীত তারকা তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, আইয়ুব বাচ্চু, নকিব খান, জেমস, হাসান, খালিদ, শাফিন আহমেদ, বিপ্লব, বেবী নাজনীন, রবি চৌধুরী, মনির খান, কনক চাঁপা, রিজিয়া পারভীনসহ অনেকের গানে উন্মাতাল ছিল তারুণ্য। সোলস, চাইম, অবসকিওর, এলআরবি, মাইলস, নগর বাউল, রেনেসাঁ, প্রমিথিউস ব্যান্ডের গান ও আধুনিক গানের অ্যালবামগুলো লাখ লাখ কপি বিক্রি হতো।

শূন্য দশকের শুরুতে সাউন্ডটেক থেকে ক্যাসেটে মুক্তি পাওয়া আসিফ আকবরের ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ অ্যালবামটি ৬০ লাখেরও বেশি বিক্রি হয়েছিল। অথচ সেই ক্যাসেট এখন বিলুপ্ত। এরপর ২০০৩ কিঙ্গাব ২০০৪ সালের দিকে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে সিডি ক্যাসেটের যুগ। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না সেই সময়ের ক্যাসেটের যুগ সম্পর্কে। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাওয়া ক্যাসেটের মাধ্যমে সিডি, ডিভিডির এই সময়কালে হারিয়ে যায় ক্যাসেট। তখন অডিও কোম্পানিগুলো সিডির মাধ্যমে গান প্রকাশ করতে শুরু করে আর এরপরই পাইরেসির শিকার হন কোম্পানিগুলো। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফ্রি ডাউনলোড করার ফলে ধ্বংসের মুখে পড়ে অডিও তথা সংগীত ইন্ডাস্ট্রি।

আধুনিক যুগের এই সময়ে আগের সেই মাধ্যমগুলো এখন হারাবার পথে। ফেসবুক, ইউটিউবের যুগে কেউ আর আগের মাধ্যমে গানকে শুনতে বা উপভোগ করতে চায় না। এই যুগে আর সেই সময়ের চাহিদা থাকে না। প্রযুক্তির প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৬৩০টিরও বেশি ক্যাসেট, সিডির দোকান।

অডিও ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা এখন সর্বোচ্চ দুই সীমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন সঙ্গীত বোদ্ধারা। একদিকে পাইরেসি, ফ্রি ডাউনলোড, প্রযুক্তির প্রভাব অন্যদিকে সিনিয়র শিল্পীদের সঙ্গে অডিও কোম্পানিগুলোর দূরত্বের কারণে অডিও ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা এখন নাজেহাল। সব মিলিয়ে ক্যাসেট বা সিডিতে গান শোনা এখন বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কারণে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে বসে গান ডাউনলোড করতে পারছে শ্রোতারা তাহলে যেখানে বিনামূল্যে গান পাচ্ছে সেখানে টাকা দিয়ে সিডি কেনার কোন যৌক্তিকতা নেই।

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে অডিও কোম্পানিগুলো। ক্যাসেট বা সিডি নিয়ন্ত্রণটা নেই কোম্পানিদের হাতে যার ফলে তারাও কাজ করছে থার্ড পার্টির মাধ্যমে। তারা তাদের কোম্পানি থেকে সরাসরি গুগলের সাথে, মোবাইল কোম্পানির সাথে কাজ করছেন। তাদের মূল আয় হয় এসব ডিজিটাল মাধ্যম থেকেই। ২০০৮ সাল থেকেই ধ্বস নামলো সিডির। আগে একটা সিডি ২০/৩০ হাজার কপি করা হলেও এখন ২০০ কপি করলেও সেটা চলা মুশকিল হয়ে যায়। এখন যা সিডি করা হয় তা শুধু প্রদর্শন আর প্রকাশনা উৎসবে দেখানোর সৌজন্যতায় করা হয়।

তবে ডিজিটাল মাধ্যমকে ভর করে মাঝখানে বাজারে যে ধ্বস নেমেছিল সে অবস্থা এখন কোম্পানিগুলো কাটিয়ে উঠেছেন। আগে বার্ষিক ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা বেচাকেনা হতো। বছর পাঁচেক আগে এটা নেমে এসেছিল শূন্যে। কিন্তু এখন গুগল আর অ্যাপস থেকে ভালই টাকা পাচ্ছেন। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার যুগ শেষ হয়েছিল সিডি আসার পর। আর এখন গান দিন দিন হয়ে উঠছে অনলাইন কেন্দ্রিক। শিল্পীরা এখন সিডি বের করেন সংগ্রহে রাখার জন্য না হয় সৌজন্য কপি দেযার জন্য; বিক্রির জন্য নয়। অনেক অডিও কোম্পানিই গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেদের আবার যারা টিকে আছে তারা এখন টেলিকম কোম্পানিগুলোর মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গান কিংবা অনলাইন যেকোনো মাধ্যমে গান বিক্রি করে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন। মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে একটা গান প্রতিবার ডাউনলোড করলে টাকা পাচ্ছে মিউজিক কোম্পানিগুলো। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কালো অধ্যায় পার করে মিউজিক কোম্পানিগুলো নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে এখন ডিজিটাল মাধ্যমে এসেছে।

অনলাইনে গান তোলার জন্য এখন কনটেন্ট প্রভাইডাররাও মাঠে নেমে গেছেন। কাইনেটিক মিউজিক এমনই একটি প্রতিষ্ঠান যারা বিভিন্ন শিল্পীদের গান অনলাইনে তোলার কাজটি করছেন। জনপ্রিয় এবং নতুন দুই কাতারের শিল্পীরাই তাদের মাধ্যমে অনলাইনে গান ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু আগে ক্যসেট বা সিডি বিক্রির মাধ্যমে শিল্পীরা সেখান থেকে টাকা পেত কিন্তু এখনকার সময়ের এই যুগে অনলাইন মাধ্যমে গান প্রকাশ করার পর গান ডাউনলোড করলে টাকা পায় কোম্পানিরা। শিল্পীর কোনও লাভ নাই। শিল্পী কিছু পায় না। শিল্পীরা দুস্থ শিল্পীর খাতায় নাম লেখাচ্ছে। যারা এই কাজের সাথে জড়িত তারাই লাভ করছে।

বিডি২৪লাইভ/আইএন/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: