ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মার্মা সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা ও পরিচিতি

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম,
বান্দরবান প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের এক দশমাংশ জায়গা জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি নিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রাম। বেশীরভাগ আদিবাসীদের বসবাস এই পার্বত্য চট্টগ্রামে। আদিবাসী জনসংখ্যার দিক দিয়ে মারমা আদিবাসীদের স্থান ২য়। অধিকাংশ মারমাদের বসবাস বান্দরবান জেলায়। বতর্মানে মারমা জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। তাছাড়া কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে কিছু মারমা বা রাখাইন বসবাস করে। কিছু কিছু মারমা নিজেদেরকে "মগ" নামে পরিচয় দিয়ে থাকে।
পটভূমিঃ মারমা শব্দটি "ম্রাইমা" শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের পার্শ¦বর্তী দেশ মিয়ানমার বা বার্মা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা নৃ-গোষ্ঠিদের আগমন। মিয়ানমার ভাষায় মারমা শব্দটি অর্থ “ম্রাইমা”। মারমাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। মারমা নৃ-গোষ্ঠি মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত জাতি। সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। মারমাদের ১০টি গোত্রের উপস্থিত পাওয়া যায়। গোত্র গুলো হচ্ছে রিগো বা খ্যংসা, কক্দাইংসা, মারোসা, ক্যক্ফ্যাসা, ফ্রাংসা, থংসা, প্যালেঙসা, ওয়ইংসা, মুরিখ্যংসা, লংদুসা ইত্যাদি।
জীবন জীবিকাঃ মারমারাদের বেশীর ভাগ লোকই পাহাড় ও বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। বতর্মানে মারমারা প্রাই শিক্ষিত। চাকুরী ও চাষাবাদের মাধ্যমে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। জুম চাষ ও বিভিন্ন কাজে মারমা আদিবাসী মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। তারা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রমী। চাকুরী থেকে শুরু করে সংসারে সমস্ত কাজ ও দেখাশুনা করে। তাই আদিবাসী মারমা সমাজে মেয়েদের সম্মান একটু বেশি। এসব কাজের ফাঁকে কাপড় বুনাসহ হাতের তৈরি নানা রকম কাজ করে। মারমারা বেশি ভাগ হাতে তৈরি পোশাক ও বার্মীজ কাপড় পড়ে থাকেন।
সমাজ ব্যবস্থাঃ ঐহিত্যগত মারমা সমাজ ব্যবস্থাপনাকে গ্রাম, মৌজা ও সার্কেল তিন পর্যায়ে ভাগ করে পরিচালনা করা হয়। গ্রাম পরিচালনায় প্রধান হচ্ছেন "কারবারী"। মোজা পর্যায়ে "হেডম্যান" এবং সার্কেল প্রধান হচ্ছে রাজা বা মাং। বতর্মানে মারমাদের দুটি সার্কেল বিদ্যমান। খাগড়াছড়িতে মং সার্কেল ও বান্দরবানে বোমাং সার্কেল। বোমাং সার্কেলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ বোমাং সার্কেলের প্রথম রাজা হচ্ছে মংচপ্রু। পিতার নাম রাজা নাইদা বায়িন যার রাজধানী নাম পেগু বার্মা। আরাকান রাজ্যের নামে অধিক পরিচিতি। আরাকান রাজ্যে একটা অংগরাজ্য বোমাংকে পরিচালনা দায়িত্ব দিয়েছিল। যেটা বর্তমান বান্দরবানে "বোমাং সার্কেল"।
বিবাহঃ মারমা সমাজে বিবাহ প্রথম পর্ব হলো "লাকপাই-পোই" বা প্রস্তুতি মূলক অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠানটি মূলত আয়োজন করা হয় আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদের জানানোর জন্য। উভয় পক্ষের সম্মতিতে ও সামাজিক রীতি অনুসারে পাত্রের পিতা-মাতা বা বন্ধু-বান্ধব কয়েকজন বয়বৃদ্ধ প্রথাগতভাবে ব্যবহার্য উপকরণ, যেমন- ১ বোতল মদ, ২৫টি সুপারী, ১বিড়া পান, বিন্নি ভাত, মিষ্টি, আঁখ ও ১জোড়া নারিকেল নিয়ে কনের বাড়িতে যেতে হয়। এসব উপকরণ কনের মা-বাবাকে প্রদান করে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং মা-বাবার সম্মতির পর মেয়ের মতামত নেয়া হয়। মেয়ের মতামত পাওয়ার পর পাত্রীপক্ষ অনুরূপ আর এক বোতল মদ পাত্র পক্ষকে প্রদান করে। এরপর জ্যোতিষ ডেকে রাশিফল ও বিয়ের দিনক্ষণ ও তারিখ ঠিক করা হয়। সবকিছু শুভ লক্ষণযুক্ত হলে পাত্রপক্ষ একটি থামী (মেয়েদের নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়) রূপা বা স্বর্ণের একটি আংটি দিয়ে পাত্রীকে আশীর্বাদ করেন। বিয়ের ২দিন পূর্বে পাত্রের বাবা বা অভিভাবক নিজ বাড়িতে গৃহ দেবতা উদ্দ্যেশ্য (চুং মং লে) পুজার আয়োাজন করে। পূজাতে দেবতার উদ্দেশ্যে ১টি শুকর. পাঁচটি মুরগী বলি দেয়া হয়। বিয়ের তারিখ ধার্য্য হলে পাত্রপক্ষ থেকে পাত্রীপক্ষের বাড়িতে ১টি মোরগসহ বিয়ের নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়। বিয়ের দিন সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি অনুসারের পাত্রের বাড়ি প্রবেশ দ্বারে ২টি কচি কলা গাছ, সাদা সুতা দিয়ে পেচানো ২টি পানি ভর্তি কলস (রিজাংও) ও সিফাইক্ও রাখে। বউ আনতে যাওয়ার সময় সিদ্ধ মোরগ, মদ তৈরি হওয়ার পূর্বে ভাত, পানি মুলির সংমিশ্রণ ১ বোতল মদ, ১টি থামি (মেয়েদের নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়) ও ১ টি বেদাই আংগি (উর্ধাঙ্গের পোষাক) সহ নানা উপকরণ নিয়ে যাওয়া হয়। বিয়ের দিন সিদ্ধ মোরগটিকে প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে বর-কনের জন্য একটি পাত্রে পরিবেশন করে। বিবাহ অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা পঞশীল গ্রহণ, মঙ্গলসূত্র পাঠ ও পিন্ড দানসহ নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। অবশেষে, বিবাহের "লাক্ ছং চা-চ" অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। এরপর থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী রূপে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে।
কৃষ্টি-সংস্কৃতিঃ মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই পোয়েঃ, সাংগ্রাইং, ওয়াছো পোয়েঃ, ওয়াগ্যোয়াই পোয়েঃ, পইংজ্রা পোয়েঃ, ফানুস বাতি উড়ানো, জলকেলি, বৌদ্ধমূতি স্নান, রথযাত্রা এ সবকে প্রদান সামাজিক উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে। মারমাদের আদি সংস্কৃতি মধ্যে রয়েছে থালা নৃত্য, পাখা নৃত্য, মাছ ধরা নৃত্য, পাংখুং, জাইক, কাপ্যা প্রভৃতি। নিজেদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মারমা সমাজে খুবই জনপ্রিয়। মাতৃভাষায় রচিত অসংখ্য ভিডিও ও অডিও গান রয়েছে। মারমারা বর্ষবরণকে প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে পালন করে থাকেন। এ বর্ষবরণকে মারমা তাদের ভাষায় ‘সাংগ্রাই পোয়েঃ বা সাংগ্রাইং উৎসব বলে থাকে। ব্যাপক আয়োজনের মাধ্যমে এ উৎসব পালিত হয়। বাংলা নববর্ষ থেকে মারমাদের সাংগ্রাই পোয়েঃ উৎসব শুরু হয়। এ উৎসব ৪দিন ব্যাপী মারমারা পালন করে থাকে।
বান্দরবান উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী-এর পরিচালক মং নু চিং মার্মা বলেন, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ এ তিনটি অধ্যায়কে মারমারা নিজেদের সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ (আবদ্ধ) করেছে। মারমা সমাজের বিভিন্ন গোত্র ও উপ-গোত্রের মধ্যে রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ও সূক্ষ তারতম্য রয়েছে। রীতিনীতি অনুসরণ ও আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে মারমা সমাজে।
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]

পাঠকের মন্তব্য: