প্রবাসে বাংলাদেশি নারীদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ!
রোকনুজ্জামান পিয়াস: ৫৫ বছর বয়স তার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হচ্ছিলেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। সৌদি আরবের গৃহকর্ত্রী তাকে বেধড়ক পেটাতো। লাঠি দিয়ে পেটাতো গিরায় গিরায়। একটু উনিশ-বিশ হলেই তার ওপর চলতো নির্যাতন। সারা শরীরেই সে নির্যাতনের চিহ্ন।
ফরিদপুরের এই নারী গত ৫ মাস ১০ দিন আগে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যান। শুরু থেকেই তার ওপর চলতে থাকে নির্যাতন। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। আর সইতে না পেরে ১০দিন পর এক কাপড়ে পালিয়ে যান ওই বাড়ি থেকে। আশ্রয় নেন সেদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের রিয়াদস্থ সেইফ হাউজে। এরপর ৫ মাস কেটে গেছে সেখানেই। বৃহস্পতিবার দূতাবাস তাকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে ওই দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ৫ মাস সেইফ হাউজে থাকলেও নির্যাতনের চিহ্ন এখনো মুছে যায়নি। তার পায়ের পাতা ফোলা।
বিমানবন্দরে নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। বলেন, আর যেন কেউ তার মতো এ অবস্থার শিকার হতে সৌদি আরব না যান। এই বয়সে তিনি কেন বিদেশ গেছেন জানতে চাইলে বলেন, দালালরা তাকে বুঝিয়েছিল, তিনি সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। তিনি একা নন, বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে ফেরত পাঠানো হয়েছে আরো ১২৬ নির্যাতিত নারীকে। তাদের সবারই একই ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে। তবে নানা ধরনের নির্যাতনের পাশাপাশি সবারই অভিযোগ, তাদের ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার ফিরে আসা এই নারীদের মধ্যে ছিল ১৬ বছরের কিশোর থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধা। তাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট এজেন্সি প্রকৃত বয়স গোপন করে পাসপোর্টে বাড়িয়ে-কমিয়ে দিয়েছে। এদিকে ফেরত আসা প্রত্যেক নারীকর্মীকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পক্ষ থেকে ২ হাজার টাকা করে সাহায্য দেয়া হচ্ছে। বোর্ডের সহকারী পরিচালক জাহিদ আনোয়ার জানিয়েছেন, ফেরত আসা ৩৩১ কর্মীর সবাইকে যাতায়াত ও খাবার খরচ বাবদ ওই টাকা দিচ্ছে। বিমানবন্দরের হেল্প ডেস্ক তাৎক্ষণিকভাবে ওই টাকা বিতরণ করছে।
গত ৮ই জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে সেইফ হাউজে আশ্রয় নেয়া নারীদের দলে দলে দেশে পাঠানো শুরু হয়। ওইদিন ফেরত পাঠানো হয় ৩৫ নারীকর্মীকে। পরদিন গত ৯ই জানুয়ারি ফেরত পাঠানো হয় ৩০ নারী কর্মী। পরদিন ১০ই জানুয়ারি ৯৯ জনের একটি নারী কর্মীর দল দেশে পৌঁছান। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফেরত আসেন ১২৭ জন। আজ রাতে আসবেন আরো ৩৫ নারী।
বৃহস্পতিবার রাতে বিমানবন্দরে ফেরত আসা নারী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৌদির কর্মক্ষেত্র ও দূতাবাসের সেইফ হাউজে তারা ১-১৬ মাস অবস্থান করেছিলেন। এই সময়ে তারা কেউই বেতন পাননি। ফিরে আসা নারীদের ভাষ্যমতে, প্রতিদিন কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে দূতাবাসের সেইফ হাউজে আশ্রয় নিচ্ছেন ৫-১৫ জন নারী কর্মী। সেখানকার প্রকৃত অবস্থা না জানানোর জন্য কড়া নিষেধ করে দেয়া হয়েছে বলে কেউ কেউ বলেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে থাকেন ফেরত আসাদের স্বজনরা। এমন একজন নারায়ণগঞ্জের হতভাগা এক কন্যার পিতা। তিনি বলেন, তার মেয়ের বয়স ১৬। কিন্তু বিদেশ পাঠানোর জন্য তার মেয়ের বয়স বাড়িয়ে ১৮ করেছে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি। তিনি বলেন, গত বছর ২৮শে নভেম্বর সুরমা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি এজেন্সি তার মেয়েকে গৃহকর্মীর কাজ দিয়ে সৌদি পাঠায়। কিন্তু যাওয়ার পরদিনই ওই বাসায় তার ওপর নির্যাতন চালায়। পরদিন সে দূতাবাসে আশ্রয় নেয়।
এ ঘটনা জানার পর থেকে ওই এজেন্সিতে যোগাযোগ করেন মেয়েকে ফেরত আনার জন্য। কিন্তু তারা ফেরত আনা বাবদ ২ লাখ টাকা দাবি করে। ফলে এতদিন পর্যন্ত দূতাবাসের সেইফ হোমেই কাটাতে হয়েছে তাকে। রাত ১০টার দিকে এই পিতার কিশোরী মেয়ে বিমানবন্দরের ২নং টার্মিনাল দিয়ে বের হন। এ সময় অপেক্ষারত বাবাকে দেখে আবেগ-আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরেন। কাঁদতে থাকেন। তার সঙ্গে কাঁদেন বাবাও। বাবা-মেয়ের এই দৃশ্য অপেক্ষারত কারোরই দৃষ্টি এড়ায়নি। এরপর একের পর এক বের হন নারী কর্মীরা। স্বজনকে দেখে কারো কারো কান্নায় সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ঝিনাইদহের ৪০ বছরের এক নারী। তার জন্য দুপুর থেকে অপেক্ষা করছিলেন তার স্বামী। তিনি জানান, তার স্ত্রী তিন মাস আগে সৌদি আরব যান। এরপর থেকেই তার ওপর নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলো। ঠিকমতো খাবার দিতো না। কি ধরনের নির্যাতন চলতো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেগুলো বলার মতো না, বুঝে নেন। তিনি বলেন, এক বাড়ির কথা বলে নিয়ে গেলেও তাকে দিয়ে ৭ বাড়ির কাজ করানো হতো।
যে মালিকের অধীনে কাজ নিয়ে গিয়েছিল তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তাকে পাঠানো হতো। তারাই তার ওপর যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে অত্যাচার চালাতো। গত ১০ দিন আগে সেখান থেকে পালিয়ে দূতাবাসে আশ্রয় নেয় তার স্ত্রী। বিমানবন্দরের টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার পর কথা বলতে চাইলে ওই নারী রাজি হননি। বলেন, স্যারেরা কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে। আপনাদের সঙ্গে কথা বললে, যারা আসার অপেক্ষায় আছে তারা আর আসতে পারবে না। তিনি বলেন, আমাদের মতো স্যারেরাও চান, যেন কোনো মেয়ে সৌদিতে কাজে না যায়।
অনুরোধের সুরে এই নারী বলেন, পারলে আপনারা মহিলা যাওয়া বন্ধ করেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব বরিশালের এক নারী জানান, প্রকৃত বয়সের চেয়ে পাসপোর্টে তার বয়স কম করে দিয়েছে দালালরা। তিনি বলেন, আমার নাতি-নাতনিও বিয়ের উপযুক্ত। তিনি বলেন, দূতাবাসের সেইফ হোমে প্রতিদিনই নারীরা বিভিন্ন বাসা থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। কোনোদিন ৫ জন, কোনোদিন ১০ জন, আবার কোনোদিন ১৫ জনও আসে। তিনি কেন ফিরে এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, তারা আমার ওপর এমন নির্যাতন করেছে যা বলার মতো না। ঘরের বাইরে একটি টিনের চালার নিচেই থাকতে দিতো। সাভারের বিরুলিয়ার আরেক নারী বলেন, সৌদিতে ১ মাস ১২ দিন ছিলাম। তাদের নির্যাতন সহ্য করতে পারছিলেন না। পালিয়ে যাওয়ার পথও পাচ্ছিলেন না। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা তাকে আটকে রাখা হতো। পরে একদিন ময়লা ফেলার জন্য বাইরে বের হন।
ওই সময় এক বাঙালির সাহায্যে তিনি পালিয়ে সেইফ হোমে চলে আসেন। তিনি বলেন, ওই বাসার মহিলা তাকে লাঠি দিয়ে মারধর করতো। এতে সারা শরীরে দাগ পড়ে গেছে তার। মাঝে মাঝে গরম পানি গায়ে ঢেলে নির্যাতন করতো বলেও তিনি জানান। রাজশাহীর ত্রিশোর্ধ্ব এক নারীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি অনীহা প্রকাশ করেন। ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ইজ্জত হারানোর কথা কাউকে বলা যায় না। এদিকে বৃহস্পতিবার সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা নারীরা জানান, এ পর্যন্ত তাদের এক মাসের বেতনও দেয়া হয়নি। নারায়ণগঞ্জের আরেক নারী জানান, তিনি নির্যাতন সহ্য করেও এক বাসায় ১৫ মাস কাজ করেছেন। কিন্তু তাকে কোনো বেতন দেয়া হয়নি। পরে পালিয়ে এক মাস আগে দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গৃহকর্তারা বলতো, তাদের কিনে আনা হয়েছে। অথচ দালালরা বলেছিল, মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে তাদের। ফিরে আসা নারীরা জানান, তাদের দূতাবাসের স্যারেরা সেখানকার কথা বলতে নিষেধ করেছেন। একইসঙ্গে কোনো নারী যেন সৌদি না যায়, সে ব্যাপারেও সচেতন করতে বলেছেন। উল্লেখ্য, ৮-১১ই জানুয়ারি পর্যন্ত ২৯০ জন নারী ফেরত এসেছেন। একদিন বিরতি দিয়ে আজ আরো ৩৫ জন নারী ফেরত আসছেন।-সূত্র: মানবজমিন
বিডি২৪লাইভ/এমআর
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: