ভাসমান পেয়ারার রাজ্য!

প্রকাশিত: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৫:৩০ পিএম

ঝালকাঠি সদর উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা, এই জলবাজারে প্রধান পণ্য পেয়ারা। সারি সারি নৌকার ওপর সবুজ-হলুদ পেয়ারা। এক কথায় খালের ওপর এক আজব-অবাক করা বাজার।

এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান হাট এটি। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) কুড়িয়ানা, আটঘর, আতা, ঝালকাঠির মাদ্রাসা। পিরোজপুর সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে আসা একই খালপাড়ে। ভীমরুলী জলে ভাসা হাটে পেয়ারা বোঝাই ডিঙি নৌকাগুলো একবার এপাশ, একবার ওপাশ, চাষিদের ভালো দামের আশায় এমন নড়চড়। খালের দু’পাশে আড়ৎ ব্যবসায়ীদের আড়ৎ, তারাই কিনবেন। বাংলাদেশের সিংহভাগ পেয়ারা উৎপাদনকারী অঞ্চলের চাষিরা ডিঙিতে বসে বিকিকিনিতে মগ্ন।

এমতাবস্থায় দক্ষিণাঞ্চলের এলাকা জুড়ে পাকা পেয়ারার মৌ-মৌ গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পাইকার এবং পেয়ারা চাষিদের বেচাকেনার ধূম চলছে পেয়ারার মোকাম (হাট-বাজার) গুলোতে। পেয়ারা বাগানে প্রায় ৩১ হাজার একর জমির উপর এ পেয়ারার রাজ্য। বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারার ভর মৌসুম শুরু হয়ে এখন প্রায় শেষের পথে।

এশিয়ার বিখ্যাত এ পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গৈয়া কিংবা সবরী বলা হয়। তবে জাতীয় ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত। আর পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা ৪টি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছে। তাই পেয়ারাকে ভালবেসে ‘বাংলার আপেল’ আবার কেউ ‘গরিবের আপেল’ হিসাবে গণ্য করে।

&dquote;&dquote;

পেয়ারার মৌসুমে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে সুস্বাদু পেয়ারা ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলার আপেল নামে খ্যাত পেয়ারা এখানে প্রচুর উৎপাদন হলেও সংরক্ষণের অভাবে চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয় প্রতিবছরই। কারণ পেয়ারা দ্রুত পেকে যায়। তাই দ্রুত বিক্রি না করতে পারলে চাষিদের পড়তে হয় লোকসানের মুখে। এ বছর পেয়ারায় দেখা দিয়েছে এনথ্রাকনোস নামক এক ধরনের ভাইরাস। যা স্থানীয়ভাবে ছিটপড়া রোগ বলে সনাক্ত করা হয়।

এছাড়া বর্ষায়ও পেয়ারা সংগ্রহ ও বিক্রিতে সমস্যা দেখা দেওয়ায় উৎপাদিত পেয়ারা বাগানেই নষ্ট হতে শুরু করে। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ থাকলে মৌসুমী এই ফল পেয়ারা বছর জুড়ে ভোক্তাদের চাহিদা মিটিয়ে চাষিরাও আর্থিকভাবে লাভবান হত। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না উঠায় এবং উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিরা পেয়ারা চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে।

আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্রের অর্ধেক এই আড়াই মাস জমে উঠে পেয়ারা বেচা-কেনা। পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টির ও বেশি ছোট বড় ব্যবসা কেন্দ্র। স্থানীয়ভাবে বলা হয় পেয়ারার মোকাম। মোকাম গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আটঘর, কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, বাউকাঠি। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসে পাইকারদের কাছে। তা কিনে ট্রলার যোগে নৌ পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

এই বছর ফাল্গুনে পেয়ারা গাছে ফুল ধরার পর অতিরিক্ত খড়ায় পানির অভাব দেখা দেয়ায় ফুল ঝড়ার পাশাপাশি অনেক গাছও মারা যায়। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পেয়ারা চাষিরা গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সার এবং মাটি দিতে পারেনি। কিন্তু তার পরেও এবার পেয়ারার ভাল ফলন হয়েছে। কেটে গেছে চাষিদের দুশ্চিন্তা।

ঝালকাঠির কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারা চাষি জাহিদ মিয়া জানান, আমাদের ভাগ্য ভালো খড়ার কারণে ফলন ভালো না হওয়ার ভয় ছিল। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে পেয়ারার ফলন ভালই হয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ পেয়ারা ৮শ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পেয়ারার দাম কমে গেছে। প্রতি মণ ২শ থেকে ২৮০ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।

পেয়ারা চাষিরা জানিয়েছে, এই অঞ্চলের সাথে সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে পেয়ারা দ্রুত বাজারজাত করা যেত। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হলে পেয়ারা চাষিদের বাগান থেকে সরাসরি ট্রাক যোগে প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতেই ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেয়ারা পৌঁছে দেয়া এবং পচন রোধ করা সম্ভব হত।

&dquote;&dquote;

ভিমরুলী দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পেয়ারার মোকাম। মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মণ পেয়ারা বিক্রি হয়। তবে বাউকাঠি থেকে ভিমরুলী হয়ে কীর্তিপাশা পর্যন্ত সড়ক পথ হলে দ্রুত প্রতি দিনের পেয়ারা প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় পৌঁছানো সম্ভব হতো। ভিমরুলী মোকাম থেকে নৌ পথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালি, ভোলা, মাদারিপুর, নাটোর, বরিশাল হাজার হাজার মণ পেয়ারা যাচ্ছে। কিন্তু সড়ক পথের যোগাযোগ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে এসব জেলায় পেয়ারা নেয়ার জন্য পাইকাররা চাষিদের আরো বেশি দাম দিয়ে পেয়ারা কিনত।

পেয়ারা বাগান ঘুরে জানা গেছে, পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠী, ধলহার, কঠুরাকাঠি, আন্দাকুল, জিন্দাকাঠি, ব্রাহ্মণকাঠি, আতা, জামুয়া, ঝালকাঠি, শশীদ, পূর্ব জলাবাড়ী, আদাবাড়ি ও জৌসার গ্রাম এবং ঝালকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়ার মোট ৩৬টি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষাবাদ হয়। কয়েক হাজার পেয়ারা বাগানে হাজার হাজার চাষি পেয়ারা চাষাবাদ করে আসছে। আর পেয়ারার চাষাবাদ ও বিপণন ব্যবস্থার সাথে ওই সমস্ত এলাকার প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

ঝালকাঠি জেলা প্রসাশক মো: হামিদুল হক বিডি২৪লাইভকে জানান, সংরক্ষণসহ কৃষি ভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হতো। যুগ যুগ ধরে পেয়ারা চাষাবাদ করে আসলেও উদ্যোক্তার অভাবে দিন দিন চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে পেয়ারা চাষিরা। যদি কোন উদ্যোক্তাগণ এগিয়ে আসেন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করব। গত বছর সরকারের উদ্যোগে ১০০ জন পেয়ারা চাষিকে প্রশিক্ষনসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছি যাতে তারা লাভবান হতে পারে। পর্যটন কেন্দ্রের জন্য আমরা ল্যানডিং স্ট্রেশন করার কথা ভাবছি যাতে পর্যটকরা নৌকায় ভালোভাবে উঠতে পারে এবং পেয়ারা চাষিরা নৌকায় পারাপার করতে পারে। আমরা আরও চিন্তা করছি আসা যাওয়ার রাস্তাটি যাতে আরও প্রশস্ত করা যায় এ ব্যাপারে এলজিইডি কথা বলেছি, তারা রাজি হয়েছে। আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আলোচনা করেছি একটি মেগা প্রকল্প স্বরূপকাঠী থেকে শুরু করে এমন একটি জায়গা ঠিক করা যেখানে রেস্ট হাউজ করা যায়, মানুষ আসলে থাকতে পারে।

বিডি২৪লাইভ/এমকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: