সন্তানের উপর ধার করা স্ট্রাটেজি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন

প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৩৭ পিএম

বিভিন্ন বাচ্চার বেড়ে উঠার ধরণ ভিন্ন। আমার বাচ্চা এক রকম বিহেভিয়ার করলেই যে সব বাচ্চা কে আমার বাচ্চার মতই হতে হবে কিংবা অন্য এক বাচ্চার বেস্ট বিহেভিয়ার দেখে মনে হবে আমার বাচ্চাকে ও এমন হতে হবে কিংবা আফসোস করা আহ! আমার বাচ্চাটা কেন এমন না? ভাল বিহেভিয়ার যে বাচ্চা করল তার বাবা মার থেকে তাদের বাচ্চাপালনের সিস্টেম অনুকরণ বা ধার করে নিজের বাচ্চার উপর সে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করা কিংবা কারো বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মত আচরণকারী না দেখতে পেয়ে তার কারণ জানার চেষ্টা না করে ওই বাবা মা কে জ্ঞান দান নিতান্তই বোকামি।

কারণ প্রতিটা বাচ্চার ব্যবহার সম্পূর্ন ভিন্ন। কোন বাচ্চা কথা কম বলে, কোন বাচ্চা বেশি, কোন বাচ্চা খুব চঞ্চল তো কোন বাচ্চা খুবই শান্ত, কোন বাচ্চা খাবার ভালবাসে তো কোন বাচ্চা খাবারে খুবই অনিহা প্রকাশ করে, কোন বাচ্চার শারীরিক-মানসিক বিকাশ খুব ভালো কোন বাচ্চা আবার তার থেকে কম কিংবা বেশি বিকশিত হচ্ছে। মোট কথা এক একটা বাচ্চা এক এক ধরনের আচরণ করবে। এটাই বাচ্চাদের ধরন।

আপনার বাচ্চাকে অন্যের মত করে নয় বরং তার নিজের মত করে বাঁচতে দিন। তাকে বোঝান ‘তুমি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তোমাকে আমি ভালবাসি, বিশ্বাস করি’। দেখুন এ কথাটা তার উপর পরবর্তীতে ভাল কাজ করতে যতটা প্রভাব খাটাবে, অন্যের থেকে ধার করা হাজারো স্ট্র্যাটেজি, আপনার হাজারো বকুনি, শাসন সব কিছু মিলে ও এর সিকি পরিমাণ কাজ করবে না। বাচ্চার থেকে দূরে নয়, তাকে অন্যের বাচ্চার সাথে তুলনা নয় বরং তার খেলার সাথী হতে বাবা-মা কে চেষ্টা করতে হবে। এদের কে প্রকৃত শিক্ষা দিতে হলে, সু শিক্ষা দিতে হলে এদের স্পেস দিতে হবে। এর থেকে আপনার ক্ষতির চেয়ে উপকার-ই বেশি হবে। Swiss Phychologist Jean Piaget এর মতে “It is with children that we have the best chance of studying the development of logical knowledge, mathematical knowledge, physical knowledge and so forth”. সুতরাং বাচ্চাদের উপর আপনার পছন্দের ধার করা Strategy চাপিয়ে না দিয়ে এদের সুযোগ দিন। ভুল হলে শোধরে দিতে আমরা বাবা মা রা তো আছি ই। কিন্তু সে ভুলটা করার সুযোগ তো তাকে দিতে হবে! ভুল না করলে সে শিখবে কিভাবে? কোনটা ভুল কোনটা শুদ্ধ বুঝবে কিভাবে?

নিজের সন্তানকে সুযোগ দিন। বাবা-মা কিংবা পরিবারের বড় সদস্য হওয়ার দরুণ তাদের আপনার সাহায্য করার দায়িত্ব যতটুকু একদম সমপরিমাণ দায়িত্ব হল সাহায্যের হাত বাড়ানোর আগে সমাধান যেন তার দিক থেকে আসে সে জন্য অপেক্ষা করা। তাকে এনকারেজ করুন বেশি করে যেন সে উৎসাহ পায় সমস্যার সমাধানে। হোক সেটা ঘরে কিংবা বাইরে খেলার সময় কিংবা যে কোন কাজে। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর আশানুরুপ ফল না আসলে কিছু সংশ্লিষ্ট ক্লো দিতে পারেন। তারপরও ব্যর্থ হলে তখন আপনার সাহায্যের হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিন। কিন্তু, অবশ্যই তাকে চেষ্টা করা থেকে কখনো বিরত করবেন না। এতে করে যা হবে, সে খেলায় অনেক সময় পাবে, আপনার সাথে talking, listening and interacting ভালো হবে যা সন্তানকে তার জীবনের প্রতিটা সমস্যাকে দক্ষতার সাথে সমাধানে সফল করবে।

সব বাচ্চা সমান বয়সে সমান কাজ না ও করতে পারে। কোন বাচ্চা এক বছরে টুকিটাকি কথা শুরু করে তো কোন কোন বাচ্চার তিন সাড়ে বছর লেগে যায় কথা শুরু করতে। কোন বাচ্চার ম্যাচুরিটি আসে খুব তারাতারি, কোন বাচ্চার দেরিতে।আমার মতে বাচ্চাদের শিক্ষাটা তাদের Discovery’র উপর ছেরে দেয়া উচিত। উন্নত দেশগুলোতে হচ্ছে ও তা। এতে করে ছেলেমেয়েদের নিজের উপর আস্থা বাড়ে, পরবর্তীকালে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে সময় উপযোগী ভাবে নিতে পারে এবং সে যা শিখছে তা ভালভাবে জেনে বুঝে শিখছে সে ব্যাপারে বিশ্বাস রাখা যায়। কোন বাচ্চা প্রায় সব বিষয়ে পারদর্শী হয়, কোন বাচ্চা আবার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে। এক্ষেত্রে অনেক বাবা-মা কেই বলতে দেখা যায় ওই ছেলে/মেয়ের সব বিষয়ে এত পারদর্শীতা, তোমার নেই কেন? নিজের সন্তানকে হেয় করে কথা বলা, এটা এভাবে কর, ওটা এভাবে কর তবে তার মত রেজাল্ট ভাল তোমারও হবে ইত্যাদি অনেক কিছু বলতে শোনা ও দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত শারীরিক, মানসিক নির্যাতন চলতে দেখা/শোনা যায়। ফলে অনেক কিশোর কিশোরীর আত্মহত্যার খবর কিংবা বিপথে চালিত হবার খবর আমরা পেয়ে থাকি হয়ত কোন গনমাধ্যমে, কিংবা কোন আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশী থেকে।

ইউনিসেফ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ছয়জনকে নিয়মিতভাবে শারীরিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়৷ শিশুদের যারা দেখাশোনা করেন তারাই এই শাস্তি দিয়ে থাকেন৷ ইউনিসেফ-এর সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশকে মারধর করেন মা-বাবাসহ অভিভাবকেরা৷ আর ৭৪.৪ শতাংশ শিশুকে মানসিক চাপ দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানো হয়৷ শিশুদের উপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির প্রভাব নিয়ে আরেকটি গবেষণা করেছে ইউনিসেফ৷

তাতে দেখা গেছে, ৮ বছর বয়সে যেসব শিশু এ ধরণের শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে তারা ১২ বছর বয়সে গিয়ে স্কুলে অংকে খারাপ স্কোর করেছে৷ শব্দভাণ্ডার গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তাদের অনীহা দেখা গেছে৷ সুতরাং শাস্তি দেয়া কিংবা আপনার পছন্দ অপছন্দ নিজের সন্তানের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া অবশ্যই তাদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে, বাড়ে উভয়পক্ষের মানসিক যন্ত্রণা, দ্বন্দ্ব, এমনকি অনেক সময় বিপথগামীও হয়ে যায় নিজের ভালবাসার সন্তান।

নিজের সন্তানকে বাস্তব দুনিয়ার সাথে পরিচয় করানো খুব জরুরি। তার সাথে কথা বলার সময় মনে রাখবেন যেন উচ্চারণ স্পষ্ট হয় এবং তার সাথে যে কথা গুলো বলছেন কিংবা সে যে প্রশ্ন গুলো করছে সেগুলোর সমাধান যেন ভৌতিক, অকল্পনীয়, অলৌকিক না হয়ে সত্য, বাস্তবাদী, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্পন্ন হয়। তার প্রশ্নের প্রতিটা উত্তর যেন তার কাছে পরিষ্কার থাকে। চলার পথে আপনার সন্তান বিভিন্ন রং, শ্রেণি কিংবা বিভিন্ন শারীরিক আকৃতির মানুষ দেখে বিভিন্ন যুক্তি বের করতে পারে তার মনগড়া। তাকে সাথে সাথে তার বানানো গল্প থেকে বের করে এনে বাস্তব ঘটনা তার কাছে পরিস্কার করার চেষ্টা করতে হবে। ওই বাস্তবতায় কতটুকু আনন্দ বিষাদ লুকানো আছে যাকে নিয়ে সে গল্প ফাঁদছিল সেটা ও তাকে বুঝতে সাহায্য করতে হবে। তার ওই গল্পে যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকে তাকে অনুভব করতে সাহায্য করতে হবে যে সে ভুল করেছে। তাকে ক্ষমা চাইতে বলুন মন থেকে। তাকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে সাহায্য করুন। তার ব্যক্তিগত কোন কাজ সে ভুল করছে জেনে ও তাকে বকাঝকা না করে বরং সে যতটুকু চেষ্টা করেছে সেটুকুর প্রশংসা করুন এই বলে ‘অনেক ভাল চেষ্টা ছিল, আমার বিশ্বাস পরবর্তীতে তুমি আরও ভাল করবে’। তারপর তাকে সঠিক নিয়ম দেখিয়ে দিন।

নিজের সন্তানকে ভালবেসে শিক্ষা দিন, নির্যাতন করে নয়। তাকে তার মত করে বাঁচতে দিন, তার পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব দিন। লোকে কি বলল তা নিয়ে না ভেবে আপনার সন্তানের উপকার কিসে হয় সে দিকে নজর দিন। কারণ দিন শেষে, ভাল হোক কিংবা খারাপ, সে আপনার-ই সন্তান। ভালো হলে লোক আপনাকে, আপনার দেয়া শিক্ষাকে ভাল বলবে, সম্মান করবে। খারাপ হলেও কিন্তু দায়ভার আপনার কাঁধেই যাবে।

লেখক: সুরমা রহমান, শিক্ষক ও সমাজকর্মী, লন্ডন, ইউ.কে

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: