বেইলি রোডের বাসভবনে সৈয়দ আশরাফের মরদেহ

প্রকাশিত: ০৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৫৪ পিএম

বেইলি রোডের সরকারি বাসভবনে নেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মরদেহ।

শনিবার (৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টার দিকে লাশবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ তার বাসভবনে নেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতসহ দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

বেইলি রোডে অবস্থান করে দেখা যায়, সন্ধ্যা থেকে প্রিয় নেতাকে শেষবারের মতো দেখতে আত্মীয়-স্বজন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাধারণ মানুষ বেইলি রোডে অবস্থান নেন। মরদেহ আসার পর কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। শ্রদ্ধা জানানোর জন্য অনেকের হাতে ছিল ফুল।

শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে তার মরদেহবাহী বাংলাদেশ বিমানের বিজি০৮৯ ফ্লাইটি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়।

বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে বিকেল থেকেই অপেক্ষা করছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব-উল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, ডা. দীপু মনি, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এ কে এম এনামুল হক শামীম, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, দলের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এ কে এম রহমত উল্লাহ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবু পঙ্কজ দেবনাথ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ এবং আরও অনেকে।

শ্রদ্ধা জানানোর পর সৈয়দ আশরাফের মরদেহ তার বেইলি রোডের সরকারি বাসভবন থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমাগারে রাখা হবে।

এরপর রোববার (৬ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সৈয়দ আশরাফের জানাজা হবে। পরে হেলিকপ্টারে করে মরদেহ নেওয়া হবে সৈয়দ আশরাফের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে; দুপুর ১২টায় কিশোরগঞ্জ পুরাতন স্টেডিয়াম মাঠে জানাজা হবে।

এরপর দুপুর ২টায় ময়মনসিংহের আঞ্জুমান ঈদগাঁ মাঠে জানাজার পর আশরাফের মরদেহ ঢাকায় আনা হবে। বাদ আছর বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সৈয়দ আশরাফ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর সৈয়দ আশরাফের স্ত্রী শীলা ইসলাম মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। এই দম্পতির একটি মেয়ে রয়েছে।

&dquote;&dquote;অসুস্থতার কারণে সৈয়দ আশরাফ গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে ছুটি নেন। এ অবস্থাতেই একাদশ সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে নৌকা প্রতীকে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার রাতে পৃথক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এ শোক জ্ঞাপন করেন।

শোক বার্তায় দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী সৈয়দ আশরাফের চলে যাওয়ার শূন্যতা অপূরণীয় উল্লেখ করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।

শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, সৈয়দ আশরাফের মৃত্যু বাংলাদেশর রাজনীতিতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। গণতন্ত্র, রাজনীতি ও সমাজ উন্নয়নে তাঁর অবদান মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

রাষ্ট্রপতি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

প্রধানমন্ত্রী তার শোক বার্তায় বলেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম-এর মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন মহৎ-প্রাণ, সৎ, নীতিবান, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারালো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হারিয়েছে একজন আদর্শবান-ত্যাগী-নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির অগ্রযাত্রা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অভিযাত্রায় ইতিহাসের ধ্রুবতারা হয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি।

বিবৃতিতে তিনি মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম-এর পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং তার শোক-সন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-১ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সৈয়দ আশরাফ। এর পূর্বে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা।

সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যেভাবে নির্লোভ ও সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন, তা সচরাচর দেখা যায় না।

প্রিয় নেতার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে হানিফ বলেন, তিনি একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন। সাধাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত সৈয়দ আশরাফ ছিলেন নির্লোভ ও নিরহংকারী। নেত্রী ও দলের প্রতিও তিনি ছিলেন অবিচল।

আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে সৈয়দ আশরাফের ভূমিকা স্মরণ করে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে যখন গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তখন সারা দেশে দলকে সুসংগঠিত করে তার মুক্তির পথ ত্বরান্বিত করেছিলেন সৈয়দ আশরাফ।

সৈয়দ আশরাফ যখন দলের সাধারণ সম্পাদক হন তখন ওই কমিটিতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি দীর্ঘদিন সৈয়দ আশরাফকে কাছ থেকে দেখারও সুযোগ পেয়েছেন।

দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সৈয়দ আশরাফের মতো ত্যাগী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও সজ্জন রাজনীতিকের শূন্যতা ‘কখনোই পূরণ হওয়ার নয়’।

মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সৈয়দ আশরাফের অবদান স্মরণ করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাংবাদিকদের বলেন, তার মতো সজ্জন, ত্যাগী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদের শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।

প্রসঙ্গত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় সংসদ সদস্য। তার পিতা বাংলাদেশের মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

সৈয়দ আশরাফুল ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। যখন আব্দুল জলিল গ্রেপ্তার হন, তখন সৈয়দ আশরাফুল আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সাথে আশরাফুলের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফুল যুক্তরাজ্যে চলে যান এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাস কালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ যুব লীগের সদস্য ছিলেন। আশরাফুল ফেডারেশন অব বাংলাদেশী ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (এফবিওয়াইইউ) এর শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালে আশরাফুল দেশে ফিরে আসেন এবং জুন ১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তিনি ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।

&dquote;&dquote;২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রীসভা গঠিত হলে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পুনরায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

২০১৫ সালের ৯ জুলাই তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেন। এক মাস এক সপ্তাহ দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিজের অধীনে রাখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।

সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও তিনি জয়লাভ করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফুল ব্রিটিশ ভারতীয় শীলা ইসলাম সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শীলা লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন এবং ২৩ অক্টোবর ২০১৭ সালে তিনি মৃত্যুবরন করেছেন। তাদের একটি মেয়ে রয়েছে (রীমা ইসলাম), যে লন্ডনের এইচএসবিসি ব্যাংকে চাকরি করেন।

বিডি২৪লাইভ/এইচকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: