ঐক্যফ্রন্টে টানাপোড়েন জামায়াত নিয়ে

প্রকাশিত: ১৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:২৪ এএম

জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে টানাপোড়েন চলছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। স্বাধীনতাবিরোধী এই দলটিকে ছাড়ার চাপে রয়েছে ফ্রন্টের নেতৃত্বে থাকা বিএনপি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর জোটের অন্যতম শরিক ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হবে। বিদেশিদের দিক থেকেও একই চাপ রয়েছে।

বিএনপির মধ্যম সারির অনেক নেতা মনে করছেন, জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকায় বিএনপি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের জোট থেকে বের করে দেয়া উচিত।

তবে ভোটের হিসাবসহ নানা কৌশলগত কারণ দেখিয়ে দলটিকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে না বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। জামায়াত নেতারা বলছেন, জোট হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাদের। সুতরাং বিএনপি চেয়ারপারসনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন, আর কেউ নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

জামায়াতকে নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও নানা রকমের সংকটে ছিল বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরামসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে জোট গড়তে দেরি করে মূলত জামায়াতের কারণে।

একপর্যায়ে ২০ দলীয় জোটের বাইরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গড়া হলেও জামায়াত নেতাদের ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে আসন ছেড়ে দেয়ায় নির্বাচনের পর অসন্তোষ ব্যক্ত করেন ড. কামাল হোসেন।

গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন শনিবার বলেছেন, নির্বাচনে জামায়াতের ২২ নেতাকে যে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া হবে, তা তিনি জানতেন না।

জামায়াতের সঙ্গে একই প্রতীকে ভোট করাকে অনিচ্ছাকৃত ভুল বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, জামায়াত ছাড়তে বিএনপিকে চাপ দেয়া যেতে পারে। অবশ্য ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলের নেতারা ড. কামালের বক্তব্যের বিরোধিতা না করলেও ২০ দলীয় জোটের শরিকরা একে নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন।

বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা যুগান্তরকে বলেন, জামায়াত ছাড়তে দেশি-বিদেশি চাপ আছে, এটা ঠিক। কিন্তু এটাও সত্য একাদশ সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম আড়াল করতে জামায়াত ইস্যু এখন সামনে আনা হয়েছে।

জামায়াতের সঙ্গে ১৯৯৯ সাল থেকে বিএনপির জোট। এই জোট আদর্শিক নয়, আন্দোলন ও ভোটের জোট। ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে গত বছর। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট রয়েছে, তা জেনেই ঐক্যফ্রন্টে এসেছে শরিক দলগুলো। জামায়াত ঐক্যফ্রন্টের নয়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক। তাই এ নিয়ে বিতর্ক অহেতুক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, জামায়াত ইস্যুতে ঐক্যফ্রন্টে কোনো ফাটল ধরার সুযোগ নেই। এই জোট অটুট থাকবে।

কারণ আমরা অভিন্ন দাবিতে একসঙ্গে আন্দোলন করছি। জামায়াত নিয়ে গণফোরামের সভাপতি হিসেবে ড. কামাল হোসেন বক্তব্য দিয়েছেন। তা ঐক্যফ্রন্টের বক্তব্য নয় বলেও জানান বিএনপি মহাসচিব।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ড. কামাল হোসেনের জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি না করার প্রস্তাবকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি।

একই সঙ্গে তার কাছে আমাদের দাবি, তিনি (ড. কামাল) যেন আওয়ামী লীগের কাছে আহ্বান জানান, যেসব জামায়াত নেতাকে আওয়ামী লীগ ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছে, যাদের ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায়ে চেয়ারম্যান, মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছে তাদের যেন বাদ দেয়া হয়। তাতে জনগণ খুশি হবে। তিনি বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন দিয়েছে। হাইকোর্টেরও একটি রায় আছে।

এরপর জামায়াতকে কেন আওয়ামী লীগ বাদ দিচ্ছে না। এখন শুনছি দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে আইন সংশোধন করা হবে। এটা নিয়েও তারা রাজনীতি করতে চায়।

সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময়ই জামায়াতকে নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন সামনে চলে আসায় কিছুটা গোঁজামিল দিয়েই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়।

পরে বিষয়টি সামনে চলে আসে নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে। বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াত নেতাদের ধানের শীষ প্রতীক দেয়ায় তা মেনে নিতে পারেননি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনেক নেতা।

এ নিয়ে মতবিরোধ ছিল বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও। বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, জামায়াত প্রথমে তাদের জানিয়েছিল তারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করবেন।

বিএনপিও সিদ্ধান্ত নেন তাদের আসনে ধানের শীষের কোনো প্রার্থী দেবে না, যা জামায়াত নেতাদের জানিয়েও দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জামায়াত তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়।

এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ সদস্যই একমত ছিলেন না। পরে স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্যের কারণে ২২ আসনে জামায়াত নেতাদের ধানের শীষের প্রতীক দেয়া হয়।

এ নিয়ে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গণফোরামের এক নেতাদের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী ওই নেতার বাকবিতণ্ডাও হয়েছিল। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, বিএনপি-জামায়াতের কোনো প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়নি। তারা সবাই বিএনপির প্রার্থী। এ নিয়েও সে সময় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল।

বিএনপির মধ্যম সারির অনেক নেতা জামায়াতকে জোটে রাখার বিপক্ষে। ছাত্রদলের একজন সহ-সভাপতি যুগান্তরকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি এবং তরুণ প্রজন্ম মনে করে জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধীদের দল।

তরুণ ভোটাররাও জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া এবং বিএনপিদলীয় ধানের শীষ প্রতীক দেয়াকে ভালো চোখে দেখেননি। বিএনপিসহ ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশি মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। অথচ জোটে জামায়াত থাকার কারণে আওয়ামী লীগসহ বাম দলের নেতারাও নানা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে।

ঐক্যফ্রন্টের নেতা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ড. কামাল সাহেবের বক্তব্য আমরা পূর্ণ সমর্থন করি। আমাদের ঐক্যফ্রন্টের মূল কথাই ছিল আমরা জামায়াতকে নেব না।

অন্যান্য রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকলে জামায়াতেরও আছে। কিন্তু অন্যরা মানবতাবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত নয়। জামায়াত ক্ষমা চাইলে তাদের রাজনীতি করতে দেয়া উচিত।

তিনি বলেন, একটি জিনিস প্রমাণিত ভোটের বাজারে জামায়াতকে দিয়ে বিএনপি কোনো লাভবান হয়নি। এখন জামায়াত যদি ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি করতে চায় তা হলে আমরা ভেবে দেখব। তা না হলে বিএনপির উচিত তাদের বর্জন করা।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, জামায়াত ধানের শীষে নির্বাচন করলেও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে নেই। তাই তারা এ বিষয়টির সুরাহা চান। জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, আমরা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট করেছি, ২০ দলের সঙ্গে নয়। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমার মনে হয় বিএনপিই জামায়াত ত্যাগ করবে।

জামায়াত সূত্র জানায়, জামায়াত ছাড়ার চাপ যেমন বিএনপিতে রয়েছে, তেমনি ২০ দলীয় জোট ছাড়ার চাপ রয়েছে জামায়াতেও। দলটির একটি অংশ মনে করে, শুধু বিএনপির সঙ্গে জোটের কারণে গত ১০ বছর তারা সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের নেতাকর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারেন না। গত ১০ বছরে বহু নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।

গ্রেফতার হয়েছেন দুই লাখের অধিক। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অন্তত ২৫ হাজার। ২০১৩ ও ২০১৫ সালের আন্দোলনে বিএনপির পাশে জামায়াত ছাড়া আর কেউ দাঁড়ায়নি। এত ত্যাগ শিকারের পরও বিএনপির কাছ থেকে তারা মূল্যায়ন পাননি। তাদের মতে, যেহেতু জোট হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাদের।

তিনি এখন কারাগারে বন্দি আছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন, আর কেউ নয়। এছাড়াও জোট না ছাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে নিজে থেকে জোট ছাড়লেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের গুজব তৈরি করবে, যা জামায়াতের রাজনীতি শেষ করে দিতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জোবায়ের যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন ও রাজনীতির জন্য জোট হয়েছে। আমরা তো জোটে আছি।

ভেঙে দেয়ার বিষয়ে পরবর্তী কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এই জোট অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, এই জোটের প্রধান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে আমাদের নেতারা আলোচনা করেই জোটটি করেছিলেন। তাই শীর্ষ নেতারা কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত জোট থাকবে। সূত্র: যুগান্তর।

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: